ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে: সাংবাদিকতা ও ইসলাম

Posted by

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে:  আজ সারা বিশ্বে যখন মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হচ্ছে, তখন বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের ওপর চাপ ও ভয়ভীতি আমাদের যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ এবং মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে।

দিবসটির ( ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে) এবারের প্রতিপাদ্য- ‘মিডিয়া ফর ডেমোক্রেসি: ‘ভয় বা পক্ষপাতিত্ববিহীন সাংবাদিকতা’।

১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে-কে `ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে` বা বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেয়া হয়।

তখন থেকে প্রতিবছর সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতিমালা অনুসরণ, বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মূল্যায়ন, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ প্রতিহত করার শপথ গ্রহণ এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত ও জীবনদানকারী সাংবাদিকদের স্মরণ ও তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় এ দিবসটিতে।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

৩ মে  ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার।

এক বিবৃতিতে বলেন, বিশ্বমুক্ত গণমাধ্যম দিবসে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে মিলে বাক স্বাধীনতার সার্বজনীন অধিকার এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা ও নাগরিকদের ওয়াকেবহাল আর সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকার কথা পুনর্ব্যক্ত করছে।

এ বছর আমরা জনগণকে কোভিড-১৯ মহামারির তথ্য জানানোর জন্য অক্লান্তভাবে, অনেক সময় কষ্টকর ও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে যাওয়া সাংবাদিকদের বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাই।

বাংলাদেশসহ সব জায়গায় সাংবাদিক, আলোকচিত্রসহ মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের জন্য অনেক সময় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।

কোভিড-১৯ রোগে অসুস্থ হয়ে পড়া সাংবাদিক ও জনসেবায় তাদের নিঃস্বার্থ অবদানকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই।

ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে উপলক্ষে একবানীতে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অদ্রে আজুলে বলেছেন, “সংকটপূর্ণ সময়ে প্রয়োজনীয় সব তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সাংবাদিকরা কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমান এই মহামারির সময়ে।”

তবে এই তথ্য জানাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নানাবিধ চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়াও ভুয়া তথ্যের বিস্তার, নানাবিধ দমনমূলক ব্যবস্থা ও সেন্সরশিপ আছে সাংবাদিকতা জগতের মাথাব্যাথা হয়ে।

অপর এক বিবৃতিতে, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ও সরকারের গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার অপরিহার্য নিয়ামক গণমাধ্যমের অবাধ ও মুক্ত ভূমিকা পালনে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

বিশেষ করে কোভিড-১৯ উদ্ভূত জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় নাগরিকদের তথ্যপ্রাপ্তি ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতে সংকটকালীন গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাগত ও স্বাস্থ্যসুরক্ষার পাশাপাশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখা নিশ্চিতকরণে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ জানিয়েছে সংস্থাটি।

বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস বা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।’

‘কোভিড-১৯ মহামারিকে দুর্নীতির মহোৎসবে পরিণত করার পাঁয়তারায় যারা লিপ্ত তাদের অশুভ তৎপরতা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম শক্তি হতে পারে মুক্ত গণমাধ্যম।’

প্রসঙ্গত, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর সাংবাদিকরা জাতির বিবেক।

গণমাধ্যম স্বাধীন হলে তার সুফল সবাই ভোগ করে। সে হিসেবে সাংবাদিকতা আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। কথায় বলে, ‘যত বড় মাথা তত বড় ব্যাথা।’

যে পেশার গুরুত্ব যত বেশি, এই প্রবাদ বাক্যের আলোকে সেই পেশার দায়বদ্ধতাও তত বেশি।

বাংলাদেশের আপামর জনগণ এ দৃষ্টিকোণ থেকেই সাংবাদিকদের ভিন্ন চোখে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে থাকে।

বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির তথা বিশ্ব মানব সম্প্রদায়ের কল্যাণে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম- এ ব্যাপারে ন্যূনতম সন্দেহ-সংশয় নেই।

বর্তমান সময়ের আধুনিক সাংবাদিকতার বিশাল পরিসরে সাংবাদিককে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে দেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়।

এখন সংবাদপত্রের ধরনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি সাংবাদিকদের কাজের পরিধিতেও পরিবর্তন এসেছে। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। তবুও সাংবাদিকদের শত্রুর অভাব নেই।

এক কথায়, একটি অনিশ্চিত পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের।

অথচ দেশের সামগ্রিক কল্যাণময় কাজে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে সংবাদমাধ্যম।

তারপরও একশ্রেণীর লোক সর্বদা তাদের যাবতীয় আক্রোশ উগরে থাকে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতি।

এ ক্ষেত্রে অবশ্য এককভাবে তাদেরও দায়ী করা যায় না।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এ জন্য সাংবাদিক নিজেও দায়ী। অর্থাৎ সাংবাদিক তার কলম, মেধা ও মননশীলতার অপব্যবহার করেছেন।

সাংবাদিকদের হাতে কলম আছে বলেই তারা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলতে পারেন না।

এমনটি সুস্থ সাংবাদিকতার বিপরীত কাজ। এটা অন্যায়ও বটে।

ক্ষেত্রবিশেষ দেখা যায়, অনেক সাংবাদিক মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রচার করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায়কে সমর্থন করছে।

ইসলামী শরিয়ত এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বিশেষ নির্দেশ প্রদান করেছে।

নিষেধ করা হয়েছে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হওয়ার।

ইসলাম বলেছে মানবকল্যাণের জন্য সত্য সংবাদ পৌছে দিতে। তাই সংবাদ সংগ্রহের সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। যেনতেন লোক থেকে সংবাদ গ্রহণ করা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে সূরা হুজরাতের ৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে লিপ্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’

হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট, যা শুনবে তা যাচাই ছাড়া বর্ণনা করা।’ [আবু দাউদ]

সততা একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় গুণ। অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকলেও সততার অভাবে অর্জিত সম্মান ধুলোয় মিশে যেতে পারে।

যেহেতু গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়, তাই গণমাধ্যমকর্মীদেরও দর্পণের মতো স্বচ্ছ হতে হবে। এটা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশবিশেষ ও বিশেষ ভূষণও বটে।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

সাংবাদিক হলেই যা ইচ্ছা তা লেখা যাবে না। এমন কিছু প্রচার করা যাবে না, যাতে মন্দ ছাড়া ভালো কিছু নেই।

এ ছাড়া সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করে সংবাদ পরিবেশনসহ অন্যের ক্রীড়নক হয়ে বা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সংবাদ পরিবশেন চলবে না।

এমন কাজ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে।’ -সূরা বনি ইসরাঈল : ৩৬

একজন সাংবাদিককে সংবাদ লিখতে হবে শতভাগ সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে। কেননা সাংবাদিক কারও পক্ষের নন। তিনি ন্যায়-ইনসাফ ও সত্যের পক্ষপাতী। সাংবাদিক বন্দী তার বিবেকের কাছে।

এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ইনসাফ কর।’ -সূরা আনআম : ১৫২

সাংবাদিকদের শুধু রাজনৈতিক সংবাদ ছাপলে চলবে না। দেশের মানুষ কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কী করছেন সেসব বিষয়ের সংবাদও প্রকাশ করতে হবে।

সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট না করা ও কারও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করে এমন বিষয়গুলো মাথায় রেখে সংবাদ লিখতে হবে।

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের কবিরা গুনাহ সম্পর্কে সংবাদ দেব না? (কথাটি রাসূল (সা.) তিনবার বলেছেন) সাহাবায়ে কেরামরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! বলুন, তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, কথাগুলো বলার সময় রাসূল (সা.) হেলান দিয়ে বসেছিলেন, অতঃপর সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। কথাগুলো বারবার বলতেছিলেন। আমরা (সাহাবারা) মনে মনে বলতেছিলাম, ‘হায়! যদি তিনি চুপ হতেন।’ [বুখারি ও মুসলিম]

যেহেতু আল্লাহতায়ালা সাংবাদিকদের মেধা দিয়েছেন, যোগ্যতা দিয়েছেন; তারা লিখতে পারেন, নতুন নতুন অনবদ্য রচনা ও গঠনমূলক লেখা সৃষ্টি করতে পারেন; তাই তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তাদেরকে প্রদান করা এই যোগ্যতা মহান আল্লাহর এক অসীম নিয়ামত, একটি আমানত। এই আমানতকে কোনোভাবেই বিনষ্ট করা যাবে না, হেলায়-ফেলায় খোয়ানো যাবে না।

লেখক, অনলাইন সংবাদপত্র সিটিজি টাইমস ডটকম এর সম্পাদক