জিভে জল আনা চাটগাঁইয়া (মেজবান) মেজ্জানের একাল-সেকাল

Posted by

চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেজবান মূলত কোন উপলক্ষ কেন্দ্র করে আয়োজিত একটি গণভোজ। মেজবান বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যবাহী একটি অনুষ্ঠান; চট্টগ্রামের ভাষায় একে বলা হয় ‘মেজ্জান’।

মেজবান

মেজবানের সংস্কৃতি প্রসারে অতিথিপরায়ণ চট্টগ্রামবাসী বেশ সফল। দেশের সীমা পেরিয়ে তা এখন বিশ্বব্যপী সমাদৃত।

মেজবান ফারসি শব্দ। এর অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। আঞ্চলিক ভাষায় একে বলা হয় ‘মেজ্জান’।

মেজবানের উৎপত্তির সঠিক সময় নির্ণয় করা যায় না। জানা যায়, চট্টগ্রামে মেজবানের প্রচলন শুরু হয় ১৮ শতকের দিকে।

তবে  ১৫০০ ও ১৬০০ শতাব্দীর প্রাচীন পুঁথি সাহিত্যে মেজোয়ানি ও মেজমান শব্দ দুটি পাওয়া যায়। মেজোয়ানি অর্থ আপ্যায়নকারী ও মেজমান অর্থ আপ্যায়ন।

হয়তো সে সময়ের মেজমান, বর্তমানে মেজবানে রূপ নিয়েছে।

স্থানীয় অসংখ্য ছড়া-কবিতার পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে এ ঐতিহ্য। বিশিষ্ট ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া লিখেছেন-

ওরে দেশের ভাই, খুশির সীমা নাই।
জলদি আইয়ু সাজিগুজি, মেজ্জান খাইবার লাই।

আর এই মেজবানের নাম শুনলেই জল আসে জিভে। শুধু কি তাই, পেটেও হাত পরে নিজের অজান্তে। এমনকি মনে পড়ে সেই মেজবানি স্বাদের খাবারের ঢেকুর।

মেজবানের খাওয়া যতটা না মজাদার, তার চেয়ে মজার ব্যাপার হলো এ কর্মযজ্ঞের আয়োজন আর রান্নাবান্না।

রেওয়াজ অনুযায়ী, মেহমানদের আপ্যায়ন এবং মেজবানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় শলা-পরামর্শের জন্য আয়োজকরা আগের রাতে বসেন, নিজেদের মাঝে দায়িত্ব বণ্টন করে নেন।

স্থানীয় ভাষায় একে বলা হয় ‘আগ দাওয়াত’ বা ‘আগদঅতী’। অন্যান্য অঞ্চলে বলে ‘পান সলাৎ’। গ্রামের দু-একজন মাতব্বরও এতে যোগ দেন।

বর্তমানের সাথে অতীতের মেজবান অনুষ্ঠানের কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

পূর্বে মাটিতে চাটাই বিছিয়ে ও মাটির সানকিতে মেহমানদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হত। বর্তমানে টেবিল চেয়ার ও সাধারণভাবে প্রচলিত থালায় খাওয়ার আয়োজন করা হয়।

মেজ্জান
রান্নায় ব্যস্ত সময় পার করছেন বাবুর্চিরা; Image Source: Flickr

আগে এক গ্রামে কোনো মেজবানের আয়োজন থাকলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে এ খবর রটে যেত। ঢোল পিটিয়ে, চুঙ্গি ফুঁকিয়ে মানুষকে জানানো হতো, আর যে যার মতো এসে খেয়ে যেত।

খোলা মাঠে পাটি বা বাশের ধাঁরা বিছিয়ে আপ্যায়ন করতেন আয়োজকরা। খাবার পরিবেশন করা হতো মাটির সানকিতে।

এখন অবশ্য যুগ বদলেছে। বদলেছে মেজবানের ধরন। খোলা জায়গার অপ্রতুলতায় এখন আয়োজন করা হয় নগরের কমিউনিটি সেন্টারে।

কার্ড বিলি করে কিংবা মোবাইলে দাওয়াত প্রদান করা হয়। মাটির সানকির প্রচলন নেই বললেই চলে।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

ডেকোরেশনের বয়-বেয়ারাদের পরিবেশনার মধ্যে তো আর গ্রামের মানুষের আন্তরিকতার সেই ছোঁয়া পাওয়া যাবে না।

অন্যদিকে, মেজবানের রান্নার রয়েছে আলাদা বিশেষত্ব। মূল পদ গরুর মাংস হলেও এই মাংস রান্নার ধরন আলাদা। মসলাও ভিন্ন।

শুধু তা-ই নয়, রান্নার ডেকচি থেকে শুরু করে চুলা পর্যন্ত আলাদা। এই কাজে দক্ষ চট্টগ্রামের বাবুর্চিরাও। বংশ পরম্পরায় তাঁরা এই ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখেছেন।

সাধারণত দুটি কারনে চট্টগ্রামে মেজবান হয়। একটি সুখ, মানে খুশি। আরেকটি শোক, মানে অনুতাপ।

যেমন কারো মৃত্যুর পর কুলখানি, চেহলাম, মৃত্যুবার্ষিকী, যাতে থাকে সম্পূর্ণ ছওয়াবের উদ্দেশ্য।

শিশুর জন্মের পর আকিকা উপলক্ষেও মেজবান আয়োজন করা হয়।

এছাড়া নির্দিষ্ট উপলক্ষ ছাড়া বা কোনো শুভ ঘটনার জন্যও মেজবান করা হয়। তবে ৮০ দশকের পর থেকে রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ মেজবান।

এর আগে আত্মীয়, পাড়া-পড়শী, বন্ধুবান্ধব ও গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য মেজবানের আয়োজন হত। বর্তমানের মেজবান অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক চিত্ত আর গাড়িওয়ালা বিত্তবানদের পদচারণা বেশি।

গরিব-দু:খি মানুষের সেখানে খোঁযে পাওয়া মুশকিল।

মেজবানের মূল খাবারের তালিকায় থাকে গরুর মাংস ও সাদা ভাত। সঙ্গে ছোলার ডাল, গরুর হাড় দিয়ে ঝোল রান্না।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিয়ে কিংবা যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত খাবার সাধারণত একবারের বেশি দেয়া না হলেও মেজবানে অতিথির চাহিদা অনুযায়ী খাবার পরিবেশন করা হয়। অর্থাৎ ইচ্ছেমতো মাংস কিংবা আহার গ্রহণ।

বিশেষ কায়দায় অঞ্চলের বাবুর্চিরা মেজবানের গরুর মাংস রান্না করেন।

দেশী-বিদেশী মসলার পাশাপাশি স্থানীয় হাটহাজারী অঞ্চলের বিশেষ ধরনের শুকনা লাল মরিচ ব্যবহারের ফলে মাংসের স্বাদ অতুলনীয় যেকোনো ভোজনরসিকের কাছে।

শুকনা এ মরিচে ঝাল কম। দাম অন্যান্য মরিচের চেয়ে বেশি। মেজবান অনুষ্ঠানে এর চাহিদাই দামে হেরফেরের মূল কারণ।
মেজবানির দাওয়াত সবার জন্য উন্মুক্ত।

গরুর মাংসের জন্য আদিকাল থেকেই চট্টগ্রাম প্রসিদ্ধ। এখানকার লাল গরু (রেড ক্যাটল অব চিটাগাং) সবচেয়ে উন্নত দেশী গরুর জাত।

মূলত চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চন্দনাইশসহ সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে এ গরু উৎপাদন হয় বেশি।

দেখতে সুন্দর এ গরু আকারে ছোট হলেও মাংস সুস্বাদু, পুষ্টিকর। মেজবানে মূলত লাল গরুর ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি।

চট্টগ্রামের মানুষ গরুর মাংস কতটা পছন্দ করেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কথিত একটি ঘটনা থেকে। জনৈক এক ব্যক্তি তার নিকটাত্মীয়কে নিয়ে ভারতে গেছেন হৃদরোগের চিকিৎসা করাতে।

ওখানে বাঙালি ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়? যথারীতি উত্তর বাংলাদেশ। ডাক্তার বললেন, কোন জেলার বাসিন্দা আপনারা?

উত্তর শুনে ডাক্তার স্মিত হেসে বললেন, আমি জানতাম, তাই আপনাকে প্রশ্ন করার আগেই বাংলাদেশ ছাড়াও চট্টগ্রাম নামটি লিখে রেখেছি।

পরে কথাচ্ছলে ডাক্তার জানালেন, ভারতে বাংলাদেশী যত মানুষের হৃদরোগের চিকিৎসা বা অপারেশন হয়, এর সিংহভাগই আসে চট্টগ্রাম থেকে।

অধিক পরিমাণে গরুর মাংস খাওয়ার কারণেই এ অঞ্চলের মানুষের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

কথিত আছে, সারা দেশে একদিনে যে পরিমাণ গরু জবাই হয়, ঠিক সমপরিমাণ হয় চট্টগ্রামে। বয়স্কদের হৃদরোগের বিষয়ে সচেতন করা হলে মেজবান সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, হায়াত মউত, আল্লার হাতত, মেজ্জান খাইয়ুম, মরি যাইয়ুম; তো কি হইয়ে। (জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। মেজবান খাব, মরলে মরব; তাতে কী?)।

চট্টগ্রামের একজন সংবাদকর্মী মাসুদ। সাংবাদিকতার সুবাধে তার সাথে পথচলা। মাঝে মধ্যে তিনি বলতেন, গরুর মাংস যে খাইনি সে জীবনে কিছুই পায়নি। বিশেষ করে মেজবানের মাংসের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল অন্যরকম।

চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েকজন ইতিহাসবিদের মতে, শতবর্ষের পরিক্রমায় মেজবান শব্দটার অর্থে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে মেজবান মানে হচ্ছে, বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আপ্যায়নের ব্যবস্থা।

অর্থাৎ সামর্থ যা-ই থাকুক না কেন, ধনী-গরীব যে-ই মেজবানের আয়োজন করবে তার অতিথির সংখ্যা নিরূপণ করা চলবে না। অর্থাৎ অতিথির সংখ্যা গুনে মেজবানের আয়োজন সম্ভব নয়।

যত অতিথি আসবে এবং যে পরিমাণ খেতে চাইবে ততটুকু পরিবেশন করাই হলো পরিপূর্ণ মেজবানের বৈশিষ্ট্য।

চট্টগ্রামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণারত এক গবেষক জানান, দশ শতকের পর চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত।

বন্দর কেন্দ্র করে এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের সূচনা হয় তখন থেকেই। পর্তুগিজ ছাড়াও আরব কিংবা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মুসলিম মনীষী এ অঞ্চলে আসতে থাকেন।

বায়েজিদ বোস্তামি, বদর শাহদের পাশাপাশি বার আউলিয়া চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন বিভিন্ন সময়ে।

ধর্মপ্রচারকরা পরিবর্তিত কমিউনিটিকে নতুন খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত করাতে মেজবান বা গরুর মাংসের মাধ্যমে ভোজের আয়োজন শুরু করেন।

ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি নতুন কমিউনিটিকে সবার সঙ্গে পরিচিত করা ও সামাজিক সংহতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে মেজবানের আয়োজন করা হতো।

কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রথায় পরিণত হয়েছে মেজবান।

এখন শুধু মুসলিমরা মেজবানিতে আমন্ত্রিত হলেও ভিন্ন ধর্মালম্বীদের জন্যও থাকে বিকল্প খাবার ব্যবস্থা।

গত কয়েক দশকে চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে মেজবান সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। চট্টগ্রামের লোকজন চট্টগ্রামের বাইরেও এ মেজবানের আয়োজন করছেন।

চট্টগ্রামের বাইরে মেজবানি সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি।

১৯১২ সালে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী বিভিন্ন পেশার চাটগাঁইয়াদের ভাব বিনিময়ের জন্য, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং সুখে-দুখে মিলেমিশে থাকার জন্য সমিতি প্রতিষ্ঠা করে।

প্রতি বছরই নানা অনুষ্ঠান উপলক্ষে চাটগাঁর লোকেরা মিলিত হতেন ও গরু জবেহ করে মেজবানি খানার আয়োজন করতেন। সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকে সমিতি ঢাকায় স্থানান্তরিত হবার পরও।

যতদূর জানা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৫ সালে সমিতির সম্পাদক ডা. আনোয়ার হোসেনের বাসায় সমিতি প্রথম মেজবান আয়োজন করে চাটগাঁর এমপি, গভর্নরদের সংবর্ধনা প্রদান উপলক্ষে।

তবে ব্যাপক আকারে রাজধানী ঢাকায় মেজবানির প্রচলন শুরু হয় জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা’র সভাপতি (১৯৬৮-৮৩) থাকাকালে।

প্রথমে ১৯৭৮ সালে ঢাকা কলেজ মাঠে মেজবান অনুষ্ঠিত হয়।

সংসদ ভবনের হোস্টেল মাঠে ও বর্তমানে মোহাম্মদপুরের শারিরীক শিক্ষা কলেজের বিশাল মাঠে মেজবান অনুষ্ঠিত হতে দেখা গেছে।

মৃত্যুর আগে কয়েকবছর ধরে চট্টগ্রামের প্রবীণ রাজনীতিবিদ সাবেক চসিক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী জাতীয় শোক দিবসে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ৩০ হাজার মানুষের জন্য মেজবানের আয়োজন করেছিল।

ঐতিহ্যবাহী মেজ্জান
শোক দিবস উপলক্ষে টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহ্যবাহী মেজবান

এর আগে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাউজান থানা আওয়ামী লীগ টুঙ্গিপাড়ায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জন্য মেজবানির আয়োজন করে। ঢাকায় চট্টগ্রাম সমিতি প্রতিবছর মেজবানের আয়োজন করে।

এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চট্টগ্রাম কমিউনিটিতে মেজবান আয়োজনের খবর পাওয়া যায়। যা চট্টগ্রামের র্ব্যান্ডসংবলিত সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে প্রচারিত।

হালের করপোরেট জগতের চট্টগ্রামের যেকোনো ব্যবসার সূচনালগ্নে মেজবান প্রথম পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে। অন্য খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করার চেয়ে মেজবানেই যে চট্টলা মজেছে, তা বুঝতে বাকি নেই বিপণন কৌশলবিদদের।

সম্প্রতি চালু হওয়া চট্টগ্রামের প্রথম পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন ব্লুর সবচেয়ে বড় খাবার হলটির নামকরণ হয়েছে মেজবান হল। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে মেজবানির মাংস বিক্রির প্রচলন শুরু হয়েছে।

মেজবান সাধারণত সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত এক নাগাড়ে খাওয়ানো হয়। আগের দিন রাতে আয়োজকদের বিশেষ আমন্ত্রণে আসা লোকজন, মেজবানির কর্মী এবং পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব ও নিকটাত্মীয়দের মধ্যে শলাপরামর্শ হয়।

ওই বৈঠকের পর সবাই একসঙ্গে খাবার খান। এটাকে চট্টগ্রামের মুসলমানরা আগ দাওয়াত বা আগ দাওতি বলে।

মূলত পরদিনের মেজবানি উপলক্ষ করেই এ আগ দাওতি অনুষ্ঠান। ফেনী-নোয়াখালী অঞ্চলে এ অনুষ্ঠানকে পান সলাত বলা হয়।

সামাজিক কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মেজবানের দাওয়াত দেয়া হতো বলে বৈরী সম্পর্কের মানুষেরও মেজবানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার নজির আছে।

মেজবানি উপলক্ষে বন্ধু ও শুভাকাক্সক্ষীসহ তাদের আত্মীয়স্বজন ও অন্য জেলার লোকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়।

সাধারণত কেউ মেজবানি খানা থেকে নিজেকে বিরত রাখে না। আমন্ত্রণ না পেলেও মেজবানের খবর পেয়ে ছুটে যান মেজবানি মাংসপ্রিয় মানুষ।

প্রায় পাঁচ দশক ধরে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান দেশব্যাপী আলোচিত হয়ে আসছে। সাদা ভাতের সঙ্গে গরু-মহিষের মাংস, ছোলার ডালে হাড্ডিসহ মাংস, সেসঙ্গে গরম নলার ঝোল। মেজবানের অন্য নাম হতে পারে ইচ্ছামতো খাওয়া।

এতে থাকে মাংসের আধিক্য। গরুর মাংসের গোড়া ও নেহারি (চট্টগ্রামের ভাষায় নলা) দিয়ে তিন-চার রকমের আইটেমে অনন্য উপাদেয় খাদ্যের আয়োজন হয়ে থাকে মেজবানে।

মূলত গরুর মাংসের উদার ও আয়েশি পরিবেশন হওয়ায় মেজবানের জন্য কোনো প্রকৃত বাজেট নিয়ে আয়োজন করা যায় না।

মেজবান
যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান

এর পরও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মানুষকে উপলক্ষ করে আয়োজন শুরু করলেও অতিথি সমাগমে পর্যালোচনা করে তাতক্ষণিকভাবে গরু জবাই দেয়া হয় অনুষ্ঠানস্থলেই।

রন্ধন প্রণালির বৈচির্ত্য ও পরিবেশনের অকৃপণতা মেজবানকে অতুলনীয় করে তুলেছে। ঐতিহ্যে লালিত মেজবান চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকেও করেছে সমৃদ্ধ।

নানা উতসব-পার্বণ ছাড়াও যেকোনো কারণে যে কেউ মেজবানের আয়োজন করতে পারেন।

উচ্চবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্মবিত্ত পরিবারগুলোয়ও মেজবানের রেওয়াজ প্রচলিত আছে।

মেজবান নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ চোখে পড়ার মতো।

চট্টগ্রামের আ লিক গানের গীতিকার, সুরকার সৈয়দ মহিউদ্দিন মেজ্যান দিএ শিরোনামে একটি গান লিখেছেন।

অঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণবের কণ্ঠে গানটি পেয়েছে অন্য মাত্রা।

আশির দশকের শুরুতে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। যদিও এ গানে ধনী-গরিবের মধ্যে মেজবানের আতিথেয়তা রক্ষার রীতি ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া যায়।

মেজ্জান দিএ মেজ্জান দিএ/ ঐ তারত, ঐ তারত; গরিবল্ল্যাই মেইট্যা বছি/ ডঁর মাইনষেরলাই বাসনত/ কি সৌন্দর্য বিছানত (মেজবান দিয়েছে ওদের ওখানে/ গরিবের জন্য মাটির পাত্র/ ধনীদের জন্য সুন্দর পাত্র, সুন্দর বিছানা) কেঅরে খাবার ঢালিঢুলি/ পান্নি পুচার লইলো; কেঅরে খাবার মাপিঝুপি/ আর দিতান-ন কইলো।

(কাউকে খাওয়াচ্ছে বেশি বেশি, খাবার চাহিদামাত্র পাচ্ছে কিনা জিজ্ঞেসও করছে/ কাউকে খাওয়াচ্ছে মেপে মেপে, চাইলে দেবে নাও বলছে।)

এছাড়া লোকজ ছড়ার মধ্যেও মেজবানের রসনাবিলাসের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়…আর নাতিন ইক্কিনি/ গোশত লাগের দশখানি, নাতিরে খাবাইয়োম/ সাধের মেজবানি। (আমার নাতিন/নাতি এতটুকু ছোট হলেও মাংস লাগবে দশখানা। নাতি/নাতনিকে খাওয়াব সাধের মেজবানি।)

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

আবার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অন্য একটি গানে দেখা গেছে, ভারতবর্ষ কিংবা বিশ্বের অন্যতম স্বাদে অতুলনীয় মাছ ইলিশের চেয়েও মেজবানি অনেক বেশি মজাদার মানুষের কাছে।

কালামইন্যা ধলামইন্যা/ আনের আদা জিরা ধইন্যা/ আর ন লাগে ইলিশ-ঘইন্যা; গরু-খাসি বুটর ডাইলর/ বস্তা দ্যাখা যায়/ মেজবানি খাতি আয়।

(নানা স্বাদের মাছ, এমনকি ইলিশ মাছও লাগবে না/ গরু, খাসি আর বুটের ডালের বস্তা দেখা যাচ্ছে। মেজবানিই সেরা।)

মেজবানকে নিয়ে ছড়া-কবিতা যেমন হয়েছে, তেমনি ধাঁধা-প্রবাদেরও শেষ নেই।

চট্টগ্রামের আ লিক প্রবাদে আছে, যার কোয়ালত নাই/ ইতাল্লাই মেজ্জাইন্যা বাড়িতও নাই। (যার কপালে নেই/ সে মেজবানেও খেতে পারে না)।

চট্টগ্রামের মেজবানের রান্নার স্বাদ আলাদা। মেজবানির রান্নার আলাদা দীক্ষিত বাবুর্চি আছে, রয়েছে বিশেষ ধরনের মসলার ব্যবহার।

হালের বুফে খাবারের শুরু হলেও চট্টগ্রামের মেজবান তারকা হোটেলের বুফে থেকেও আকর্ষণ করে এখানকার মানুষদের।

তাদের রয়েছে আতিথেয়তার সোনালি ঐতিহ্য। এখানকার মানুষ অতিথিকে আপ্যায়নের মাধ্যমে তৃপ্তি লাভ করে।

ধর্মীয় সাধকদের পদ¯পর্শে ধন্য চট্টগ্রাম। বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম ধর্মীয় পীর-অলি-বুজুর্গরা শায়িত আছেন পবিত্র এ ভূমিতে।

এদের জন্য বার্ষিক ফাতেহা বা ওরশ উদযাপনের মাধ্যমে যেমন দোয়া করা হয়, তেমনি সাধারণ মৃত মানুষের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে।

বেহেশত লাভের অন্যতম উপায় হিসেবে ওয়ারিশরা গরিব কিংবা বন্ধু-আত্মীয়দের তৃপ্তিসহকারে খাওয়ান।

মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা, মেজবানের মাধ্যমে খাওয়ার পর তৃপ্তিসহকারে খোদার কাছে যদি কেউ মোনাজাত করে, তাহলে বিধাতা তা কবুল করেন।

এজন্যও মেজবান আয়োজনে লোকজন এগিয়ে আসেন। তৃপ্তিদায়ক খাবারের মাধ্যমে মনোবাসনা পূরণেও ধনী-গরিব সবাই মেজবানের আয়োজন করে।

মেজবান আয়োজন করে এখানকার কেউ কেউ ফতুর হয়েছেন বলেও খবর পাওয়া যায়।

তৎকালে মেজবান খাওয়ানো হতো চাটাই বা দরমা বিছিয়ে। সারি করে বসিয়ে মাটির সানকিতে মেজবানের দৃশ্য এখনো চট্টগ্রামের প্রবীণদের স্মৃতিকাতর করে।

কারণ এখন আধুনিক সাজসজ্জার মাধ্যমে মেজবানের আয়োজন করা হয়। তা সত্ত্বেও এর মূল উপাদান গরুর মাংস, ছোলার ডালের সঙ্গে মাংস ও গরুর হাড়ের ঝোল হারায়নি।

মেজবান চট্টগ্রামের মানুষের জীবনে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি অনুষ্ঠানের নাম। আগত অতিথি ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাই এক হয়ে যায় মেজবানে।

এখানকার মানুষের বিশ্বাস, অনেক সময় ফকির দরবেশগণ ঈমানী পরীক্ষার জন্যে ছদ্মবেশে আসেন। ছদ্মবেশী ফকির দরবেশ সন্তুষ্ট হলে সেই মেজবান কবুল হয়ে যায়।

তাই সাবধান হয়ে সব অতিথিকে সমান চোখে দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো খাওয়ানো হয়।

এভাবে মানুষকে মেজবান খাওয়ানোর চাটগাঁয়ের এ ভোজন সংস্কৃতি দিন দিন সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ছড়িয়ে পড়ছে মেজবানের খ্যাতিও।

মতামত দিন