পান্তা ভাত – রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ থেকে সুন্দর ত্বক -সবই পাবেন!

Posted by

পান্তা ভাতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ থেকে সুন্দর ত্বক -সবই পাবেন। বাংলার এই সাধারণ খাবারেই লুকিয়ে বহু পুষ্টিগুণ।

পান্তা ভাতগরমে অনেকেরই প্রিয় খাবার পান্তা ভাত। পান্তাভাত পুষ্টিগুণের দিক দিকে একশোয় একশো! এই পান্তা ভাতের ওপরেই গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীদের একটি দল।

ভারতের আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়, যাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষি জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মধুমিতা বড়ুয়া।

পান্তা ভাত নিয়ে সম্ভবত এটাই একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা।

এই গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল পান্তা ভাতে কী আছে এবং এসব উপাদান শরীরের জন্য কতোটা উপকারী বা অপকারী সেগুলো খুঁজে বের করা। এই গবেষণার ফলাফল পরে এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত হয়েছে।

যেসব দেশে ভাত প্রধান খাবার, মূলত সেসব দেশে ভাত পানিতে ভিজিয়ে খাওয়ার সংস্কৃতি চালু আছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আবহাওয়া অত্যন্ত গরম এবং আর্দ্র হওয়ার কারণে খুব সহজেই ভাত নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু পানিতে ভিজিয়ে রাখার কারণে এই খাবার দ্রুত নষ্ট হয় না।

কীভাবে পান্তা ভাত বানাবেন?

মূলত সংরক্ষণের কথা বিবেচনা করেই এই পান্তা ভাতের চল শুরু হয়। পান্তা ভাত হলো ভাত সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি।

সাধারণত আগের দিন রাতের খাবারের জন্য রান্না করা ভাত বেঁচে গেলে সংরক্ষণের জন্য এই ভাতকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিতে প্রায় এক রাত ডুবিয়ে রাখলেই তা পান্তায় পরিণত হয়।

ভাত পুরোটাই শর্করা। ভাতে পানি দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারী ব্যাক্টেরিয়া বা ইস্ট এই শর্করা ভেঙ্গে ইথানল ও ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরির ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায় (pH কমে) তখন পচনকারী ও অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।

বিজ্ঞানী মধুমিতা বড়ুয়া বলছেন, “এই প্রক্রিয়ায় ভাতের মধ্যে থাকা কার্বোহাইড্রেট ভেঙে যায়। এছাড়াও ভাতের মধ্যে ফাইটেটের মতো যেসব এন্টি-নিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর থাকে সেগুলোরও ক্ষয় হয় এবং ভাতটাও হাইড্রেট হয়ে থাকে।”

পান্তাভাতের বিভিন্ন গুণ:

পুষ্টিবিদরা বলেন, পান্তা ভাত হলো শক্তিদায়ক খাবার।  এই ভাতের ক্যালসিয়াম সাড়ে তিনশো গুণ পর্যন্ত এবং আয়রন প্রায় ৬০ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে পান্তা ভাতে ব্যবহার করা পানির জীবাণুমুক্ত হওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে

  • ভিটামিন বি টুয়েলভ: ফার্মেন্টেশনের(গাঁজন) ফলে পান্তা ভাতে জন্য ভিটামিন বি টুয়েলভ বেড়ে যায়। এটি ক্লান্তি দূর করে। কিছু ক্ষেত্রে অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করে।
  • অ্যাসিডিটি থেকে মুক্তি: বিজ্ঞানীদের মতে পান্তাভাত পিএইচ ব্যালেন্স করতে সাহায্য করে। আলসার রোগীদেরও সুফল দেয় ।
  • নতুন মায়েদের জন্য: ফারমেন্টেশনের ফলে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এটি স্তন্যপান করানো মায়েদের দুগ্ধ উত্পাদনে সাহায্য করে।
  • কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা: ন্যাচারাল ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়তা করে।
  • রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে এটি বেশ কার্যকরী। সাধারণ ভাতের তুলনায় এতে সোডিয়ামের পরিমাণ কম। অন্যদিকে পটাশিয়ামের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি।
  • রিহাইড্রেশন: পান্তা ‘বডি রিহাইড্রেটিং ফুড’ হিসেবে পরিচিত।গরমকালের খাবার হিসেবে পান্তার জুরি মেলা ভার।
  • ওজন কমাতে সহায়ক: ফারমেন্টেশনের কারণে পান্তায় কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাটের পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে ওয়েট লসে কার্যকরী হয়।তবে অবশ্যই সেটা সীমিত পরিমাণে খেতে হবে।
  • ঝকঝকে ত্বক: পান্তা ভাতকে ‘বিউটি সিক্রেট অফ এশিয়া’ বলা হয়। কারণ এটি কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের ইলাস্টিসিটি বৃদ্ধি করে। ফলে ত্বক মসৃণ, টানটান ও উজ্জ্বল দেখায়।
  • মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে ভরপুর: পান্তা ভাতে অনেক মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের প্রাপ্যতা অনেক বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ – ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রনের মতো উপাদানের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়। ১০০ গ্রাম সাধারণ ভাতে ৩.৪ mg আয়রন থাকে। অন্যদিকে পান্তা ভাতের ক্ষেত্রে সেটাই দাঁড়ায় প্রায় ২১ গুণ, ৭৩.৯১mg।
  • কোলেস্টেরল হ্রাস: পান্তায় কিছু রেজিস্ট্যান্স স্টার্চ তৈরি হয়। এটি অনেক ক্ষেত্রে সিরাম কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
  • উপকারি ব্যাকটেরিয়া: প্রোবায়োটিক্সে ভরপুর পান্তা ভাত। এটি হজমশক্তি রক্ষায় সাহায্য করে। সেই সঙ্গে পান্তা সারাদিন কাজ করার জন্য শক্তি যোগাতে সাহায্য করে ।

পান্তাভাতের উপকারিতা

পান্তাভাতপুষ্টিগুণে ভরপুর এই পান্তা ভাত। চিকিৎসকরা বলছেন, জীবনের যাবতীয় শক্তি নাকি পান্তায় রয়েছে। তাদের দাবি, শরীর চর্চা না করেও পান্তা ভাত খেয়ে বলিষ্ঠ শরীর আর উজ্জ্বল ত্বক, চুলের অধিকারী হতে পারেন যে কেউই।

বিজ্ঞানী মধুমিতা বড়ুয়া বলছেন, পান্তা ভাতে থাকা পুষ্টিকর পদার্থগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটিকে শক্তিশালী করে।

দেহের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে আয়রন যেটা পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। শরীরে হাড়গুলোকে শক্ত রাখে ক্যালসিয়াম। শরীরে নিঃসৃত এনজাইমকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে ম্যাগনেসিয়াম।

“এছাড়াও পান্তা ভাতে রয়েছে আইসোরহ্যামনেটিন-সেভেন-গ্লুকোসাইড ফ্ল্যাভোনয়েডের মতো মেটাবলাইটস যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।”

এছাড়াও গরমের সময় পান্তা ভাত শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে।

আমেরিকা নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশন-এর গবেষণা বলছে, ভাত জলে ভিজিয়ে রাখলে পাকস্থলী প্যানক্রিয়াটিক অ্যামাইলেজসহ আরও কিছু এনজাইমের কার্যকারিতা বহুগুণ বেড়ে যায়।

ফলে পান্তা ভাতের জটিল শর্করাগুলো খুব সহজেই হজম হয়ে যায়।

এছাড়া পান্তা ভাত ভিটামিন বি-৬ ও ভিটামিন-১২ এর ভালো উৎস। এছাড়া দেহের বহু উপকারী ব্যকটেরিয়া পান্তা ভাতে তৈরি হয়।

পান্তাভাতের অপকারিতা

আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় পান্তা ভাতের কোনো খারাপ দিক পাওয়া যায় নি। তবে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এই খাবার ক্ষতিকর কীনা সেটা জানতে তারা এখনও কাজ করছেন।

তবে মধুমিতা বড়ুয়া বলেছেন, ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ভাতের ফারমেন্টেশন হলে সেখানে অ্যালকোহলের উপাদান তৈরি হয় এবং সেই পান্তা ভাত খাওয়ার পর শরীর ম্যাজ ম্যাজ করে ও ঘুম পেতে পারে।

এছাড়াও পান্তা ভাত যদি পরিষ্কার পাত্রে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি করা না হয়, তাহলে সেখানে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। তিনি জানান, সেই ভাত খেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়বে।

শেষ কথা

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যা, দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা- এসব অঞ্চলেও জনপ্রিয় খাবার এই পান্তা ভাত।

তবে একেক জায়গায় পান্তা ভাতকে একেক নামে ডাকা হয়।

থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন, ইন্দোনেশিয়াতেও ফার্মেন্টেড রাইস খাওয়া হয় তবে সেটা তৈরি করার প্রক্রিয়া ও স্বাদ পান্তা ভাতের চেয়ে আলাদা।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

মতামত দিন