স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপরই চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে এই অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র সম্প্রচার শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল এ বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে।
‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। এ বেতার কেন্দ্রের সূচনা সঙ্গীত হিসাবে প্রচারিত হতো “জয় বাংলা, বাংলার জয়” গানটি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রার প্রথম অধিবেশনের দিনটি ছিল কবি নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ১১ জ্যৈষ্ঠ তথা ২৫ মে তারিখ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিনের সংবাদসহ যেসব অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তার মধ্যে ‘চরমপত্র’ ও ‘জল্লাদের দরবার’ অন্যতম।
জল্লাদের দরবার-এ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অমানবিক চরিত্র ও পাশবিক আচরণকে তুলে ধরা হতো।
এছাড়াও কোরআন তেলাওয়াত, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা উদ্ধৃত ‘বজ্রকণ্ঠ’, রণাঙ্গনের সৈনিকদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান, সংবাদ, নানা ধরনের কথিকা, জীবন্তিকা, গান, কবিতা, নাটক, নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা ইত্যাদি প্রচার হতো।
যাত্রা
২৬ মার্চ সন্ধ্যায় যাত্রার পর; ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ব্যাপক বোমাবর্ষণে অচল হয়ে যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)।
এ বিমান হামলায় কেউ হতাহত না হলেও বেতার কেন্দ্র এবং সম্প্রচার যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এর ফলে সেখান থেকে সম্প্রচার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল কেন্দ্রটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাগাফায় একটি শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটারের সাহায্যে এর দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু করে।
এ সময় অনুষ্ঠান রেকর্ড করে সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে শর্ট ওয়েভে প্রচার করা হতো।
পরবর্তীকালে দশজনের একটি সম্প্রচার দল নিয়ে এই বেতার কেন্দ্র শালবাগান ও বাগাফা হয়ে বেলুনিয়া ফরেস্ট হিলস রোডে স্থানান্তরিত হয়।
এর মধ্যে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর ২৫ মে বেতার কেন্দ্রটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয় এবং একই দিনে সেখানে এটি তার কার্যক্রম শুরু করে।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- ইতিহাসের সাক্ষী চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি: নির্মল ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে ৭৩১ যোদ্ধা
- বাংলাদেশ বেতার এর এ টু জেড
- আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান গুলো
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্থায়ী সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর স্বাধীন দেশের বেতার কেন্দ্র হিসেবে এর নতুন নাম হয় ‘বাংলাদেশ বেতার’।
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসে এবং সেদিন থেকেই স্বাধীন দেশের রেডিও হিসেবে বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার কাজ শুরু হয়।
যা এতকাল রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।
স্বাধীনতা ঘোষণা
এ সম্পর্কে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক কামাল লোহানী‘র বয়ান হলো: এ বেতার কেন্দ্র, যা মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিল অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে।
কালুরঘাট বেতার প্রক্ষেপণ কেন্দ্রে থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন।
গণহত্যা চালানোর জন্য হানাদার বাহিনী হিসেবে পাকিস্তানিরা যে হামলা চালিয়েছিল সাধারণ মানুষের ওপর, সেই পরিস্থিতিতে মেজর জিয়ার ঘোষণা পাঠ দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে থেকে – স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
বেশ কয়েকজন বেতার কর্মী স্বাধীনতার পক্ষে জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রকে কাজে লাগানোর চিন্তা করেন এবং এর নতুন নাম দেন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের আয়ু ছিল মাত্র দুই দিন। ২৬ ও ২৭ মার্চের অধিবেশনেই শুধু ‘বিপ্লবী’ নামটি ছিল।
২৮ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেওয়া হয়।
এদিন থেকে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নতুন নাম হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এর নাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
যারা ছিলেন
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এরং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই বেতার কেন্দ্র জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তারা হলেন-
প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মী
বেলাল মোহাম্মদ- তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতারের সম্প্রচারক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ- ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল।
সৈয়দ আবদুস শাকের- চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন বেতার প্রকৌশলী, আবদুল্লাহ আল ফারুক- তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক, মোস্তফা আনোয়ার- তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক, রাশেদুল হোসেন- তৎকালীন কারিগরী সহকারী।
আমিনুর রহমান- তৎকালীন কারিগরী সহকারী, শারফুজ্জামান- তৎকালীন কারিগরী পরিচালক, রেজাউল করিম চৌধুরী- তৎকালীন কারিগরী পরিচালক, কাজী হাবিবউদ্দিন আহমেদ মনি- বেতারকর্মী নন।
এ বেতার কেন্দ্রের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
এ ছাড়াও এসব নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের প্রথম পর্যায়ে যারা সহায়তা করেছেন, তারা হচ্ছেন- ড. মোহাম্মদ শফি, বেগম মুশতারি শফি, মির্জা নাসিরউদ্দিন, আবদুল সোবহানসহ অনেকে।
অনুষ্ঠান বিভাগে ছিলেন
শামসুল হুদা চৌধুরী- সিনিয়র অনুষ্ঠান সংগঠক, আশফাকুর রহমান খান- অনুষ্ঠান সংগঠক, মেজবাহ উদ্দীন আহমদ- অনুষ্ঠান সংগঠক, বেলাল মোহাম্মদ- অনুষ্ঠান সংগঠক।
টি এইচ শিকদার- অনুষ্ঠান প্রযোজক, তাহের সুলতান- অনুষ্ঠান প্রযোজক, মুস্তফা আনোয়ার- অনুষ্ঠান প্রযোজক, আব্দুল্লাহ আল ফারুক- অনুষ্ঠান প্রযোজক, মাহমুদ ফারুক- অনুষ্ঠান প্রযোজক, আশরাফুল আলম- অনুষ্ঠান প্রযোজক (চুক্তিবদ্ধ)।
আলী যাকের- ইংরেজি অনুষ্ঠান প্রযোজক, মনতোষ দে- প্রযোজক, নজরুল ইসলাম অনু- অনুষ্ঠান প্রযোজক (জয়বাংলা পত্রিকায় কর্মরত)।
কাজী হাবিব উদ্দীন আহমদ- উপ সম্পাদক (সংগীত বিভাগ), শহীদুল ইসলাম- সংবাদ পাঠক, ঘোষক। আলী রেজা চৌধুরী- সংবাদ পাঠক, ঘোষক। মনজুর কাদের- সংবাদ পাঠক, ঘোষক।
আবু ইউনুস- ঘোষক, মোতাহের হোসেন- ঘোষক, মোহাম্মদ মোহসিন রেজা- ঘোষক, এ কে শামসুদ্দীন- প্রেজেন্টেশন সুপারভাইজার।
সমর দাশ- সংগীত পরিচালক, সাইফুর রহমান- রেকর্ডিং সুপারভাইজার (সংগীত), সৈয়দ হাসান ইমাম- প্রযোজক (নাটক), রণেশ কুশারী- প্রযোজক (নাটক)। রঙ্গলাল দেব চৌধুরী- শিল্পী, মফিজ আঙ্গুর- শিল্পী।
সাদেকীন- স্ক্রিপ্ট লেখক, আবদুল তোয়াব খান- স্ক্রিপ্ট লেখক, মোস্তাফিজুর রহমান- স্ক্রিপ্ট লেখক, নাসীম চৌধুরী- স্ক্রিপ্ট লেখক, ফয়েজ আহমেদ- স্ক্রিপ্ট লেখক, বদরুল হাসান- স্ক্রিপ্ট লেখক।
প্রকৌশল বিভাগে ছিলেন
সৈয়দ আবদুস শাকের- রেডিও প্রকৌশলী, রাশেদুল হোসেন- কারিগরী সহকারী, আমিনুর রহমান- কারিগরী সহকারী, মোমিনুল হক চৌধুরী- কারিগরী সহকারী, প্রণব দে- কারিগরী পরিচালক।
রেজাউল করিম চৌধুরী- কারিগরী পরিচালক, এম শারফুজ্জামান- কারিগরী পরিচালক, হাবিবউল্লাহ চৌধুরী- কারিগরী পরিচালক।
বার্তা বিভাগে ছিলেন
কামাল লোহানী- সংবাদ ভারপ্রাপ্ত, মনসুর মামুন- উপ সম্পাদক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ- উপ সম্পাদক, সুব্রত বড়ুয়া- উপ সম্পাদক, মৃণাল কুমার রায়- উপ সম্পাদক।
রণজিত পাল চৌধুরী- উপ সম্পাদক, পারভীন হোসেন- সংবাদ পাঠক, এজাজ হোসেন- নিরীক্ষণ, রসূল আশরাফ চৌধুরী- নিরীক্ষণ।
জাহিদ সিদ্দিকী- উর্দু সংবাদ উপ-সম্পাদক, শহীদুর রহমান- উর্দু সংবাদ উপ-সম্পাদক, নুরুল ইসলাম সরকার- সংবাদ পাঠক।
প্রশাসন বিভাগে ছিলেন
অনিল কুমার মিত্র- অ্যাকাউন্টেন্ট, আশরাফ উদ্দীন- শ্রুতিলেখক, কালীপদ রায়- মুদ্রাক্ষরিক।
মহীউদ্দীন আহমদ- অফিস সহকারী, আনোয়ারুল আবেদীন- অফিস সহকারী, এস এস সাজ্জাদ- স্টুডিও নির্বাহী ও অভ্যর্থক।
দুলাল রায়- অনুলিপিকার, নওয়াব জামান চৌধুরী- অনুলিপিকার, বরকত উল্লাহ- অনুলিপিকার, একরামুল হক চৌধুরী- অনুলিপিকার।
এ ছাড়া আরও ছিলেন
গীতিকার: সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, টি এইচ শিকদার প্রমুখ।
শিল্পী: সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অরুন গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যাটার্জী, এম চান্দ, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, নমিতা ঘোষ, স্বপ্না রায়, জয়ন্তী লালা, অজিত রায়, সুবল দাশ, কাদেরী কিবরিয়া, লাকি আখন্দ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, মনোয়ার হোসেন খান, বুলবুল মহালনবীশ, ফকির আলমগীর, মকসুদ আলী সাই, তিমির নন্দী, মিতালী মুখার্জী, মলয় গাঙ্গুলী, রফিকুল আলম প্রমুখ।
সংগীত রচনা: প্রনোদিত বড়ুয়া।
যন্ত্র সংগীত: শেখ সাদী, সুজেয় শ্যাম, কালাচাঁদ ঘোষ, গোপী বল্লভ বিশ্বাস, হরেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী, সুবল দত্ত, বাবুল দত্ত, অবীনাশ শীল, সুনীল গোস্বামী, তড়িৎ হোসেন খান, দিলীপ দাশ গুপ্ত, দিলীপ ঘোষ, জুলু খান, রুমু খান, বাসুদেব দাশ, সমীর চন্দ, শতদল সেন প্রমুখ।
ঘোষক: শেখ সাদী, শহিদুল ইসলাম, মোতাহের হোসেন, আশরাফুল আলম, অনিল কুমার, আবু ইউনুছ, জাহেদ সিদ্দিকী, মনজুর কাদের।
গ্রন্থাগারিক: রঙ্গলাল দেব চৌধুরী। স্টুডিও কর্মকর্তা: এস এম সাজ্জাদ।
এ ছাড়া অনেকেই বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলেন। অনেকের নাম হয়তো এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি।
স্বাধীন বাংলা বেতারের সেরা গানগুলো
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত যে দেশাত্মবোধক গানগুলো মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা যুগিয়েছে।
জয় বাংলা, বাংলার জয়: দেশ বরেণ্য সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমত উল্লাহর কণ্ঠে এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেরা গান।
বাংলার আকাশে যতদিন সূর্য উঠবে, এই গান ও তার আবেদন ততদিন থাকবে।
গানটির কথা লিখেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুর করেন আনোয়ার পারভেজ।
কারার ঐ লৌহকপাট: গানটি যুদ্ধকালীন সময়ে মানুষের মনে উদ্যম ও শক্তি সঞ্চার করে।
গানটির কথা ও সুরারোপ করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি: গানটি প্রচারের পর জনমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
যুদ্ধ চলাকালে এ গানটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। সুর করার পাশাপাশি গানটি কণ্ঠে তোলেন আপেল মাহমুদ।
তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে: দেশাত্মবোধক চেতনায় জাতিকে এক করার জন্য, একই মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করার জন্য তখন এ রকম গানের বিকল্প ছিলো না।
এই গানটির কথা ও সুরারোপ করেন আপেল মাহমুদ।
যৌথভাবে আপেল মাহমুদ ও রথীন্দ্রনাথ রায়’র কন্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত গানের মধ্যে এটি অন্যতম সেরা।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে: গোবিন্দ হালদারের কথায় গানটির সুরারোপ করেন আপেল মাহমুদ।
গানটি কণ্ঠে তোলে জনতার মাঝে দেশপ্রেমের চেতনা জাগান স্বপ্না রায়।
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল: এটি এমন একটি গান, যার কথা, সুর এবং গায়কী লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহী করে তুলেছিল অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যাওয়ার।
এই গানটির গীতিকার গোবিন্দ হালদার। সুরারোপে সমর দাস। গানটি কয়েকজন শিল্পীর সমবেত কণ্ঠে প্রচার করা হয়।
সালাম সালাম হাজার সালাম: গানটি আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই মানুষের মুখে মুখে রটতে থাকে।
এর কথা লিখেছেন ফজলে খোদা। সুরারোপ করেন আব্দুল জব্বার নিজেই।
শোনো একটি মুজিবরের থেকে: এটি ছিল সেই গান, যেটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার আগেই ভারতের কোনো এক বেতার থেকে বাজানো হয়েছিল।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার’র কথায় গানটি সুরারোপের পাশাপাশি কণ্ঠে তোলেন অংশুমান রায়।
পরে স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য নতুন করে কণ্ঠ তোলেন আব্দুল জব্বার।
জনপ্রিয় অনুষ্ঠান
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল অনুষ্ঠান এম আর আখতার মুকুল উপস্থাপিত চরমপত্র।
চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটির নামকরণ করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কর্মী আশফাকুর রহমান খান।
এই অনুষ্ঠানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অসংলগ্ন অবস্থানকে পুরনো ঢাকার আঞ্চলিক ভাষার সংলাপে তুলে ধরতেন এম আর আখতার মুকুল।
‘চরমপত্র’ অনুষ্ঠানটি ২৫শে মে থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রচারিত হয়েছে।
অনবদ্য এ অনুষ্ঠানটির প্রতিটি অধ্যায়ের রচয়িতা ও কথক ছিলেন কথাযোদ্ধা এম আর আখতার মুকুল (১৯২৯-২০০৪)।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- ভাসানচর: আমূল বদলে যাওয়া এক দ্বীপের গল্প!
- কাপ্তাই বাঁধ প্রকল্প: বাংলাদেশের একমাত্র ‘পরিবেশবান্ধব’ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
- ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিল: চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার
মানসম্মত রেকর্ডিং স্টুডিওর অভাবে টেপ রেকর্ডারে ‘চরমপত্র’ রেকর্ড করা হতো।
৮-১০ মিনিটের এই টেপ নিয়মিতভাবে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের ট্রান্সমিটার থেকে সম্প্রচার করা হতো।
‘চরমপত্র’র প্রতি পর্বের রচনা ও ব্রডকাস্টিংয়ের জন্য এম আর আখতার মুকুল পারিশ্রমিক হিসেবে পেতেন মাত্র ৭ টাকা ২৫ পয়সা।
এছাড়া, আরেক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘জল্লাদের দরবার’ এ ইয়াহিয়া খানকে “কেল্লা ফতে খান” হিসেবে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ফুটিয়ে তোলা হত। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন কল্যাণ মিত্র।
এ অনুষ্ঠানে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অমানবিক চরিত্র ও পাশবিক আচরণকে তুলে ধরা হতো।
এই ব্যঙ্গাত্মক সিরিজে ‘কেল্লা ফতেহ খান’ ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজু আহমেদ।
অন্যদিকে, “বজ্র কন্ঠ” অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের অংশবিশেষ সম্প্রচার করা হত।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মুক্তিকামী লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ওই ভাষণকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা—ইউনেসকো।
তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।