চট্টগ্রাম কলেজ দেশের ঐতিহ্যবাহী ও শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রথম এই কলেজ; ঢাকা কলেজের পরে বাংলাদেশে স্থাপিত দ্বিতীয় কলেজ।
প্রাচ্যের রানি চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম কলেজ। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বঙ্গীয় নবজাগরণের যে গান ধ্বনিত হয়েছিল এই কলেজে, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।
শুধু শিক্ষার বিস্তারে নয়, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের তীর্থকেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম কলেজ।
ঔপনিবেশিক শোষণ, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে রক্তস্নাত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়—এই তিনটি কালের সাক্ষী হয়ে গৌরবের সার্ধশতবর্ষে পদার্পণ করেছে হিরণ্ময় ঐতিহ্যের আধার এই বিদ্যাপীঠ।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফেরদাউস খান দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম অব টুডে: আ কম্পারেটিভ স্টাডি অব থ্রি স্ক্রিপ্টস নামক পুস্তক প্রকাশ করেন।
১৯৬২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতব্যাপী কলেজ ক্যাম্পাসে নির্মাণ করা হয় এই অঞ্চলের প্রথম শহীদ মিনার।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কলেজের শিক্ষক পরিষদের সভা আহ্বান করে তৎকালীন অধ্যক্ষ আবু সুফিয়ান মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ঘোষণা করেন।
এছাড়া, ১৯২৬ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, ১৯২৯ সালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ১৯৪৬ সালে জওহরলাল নেহরু, ১৯৭০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ ক্যাম্পাসে আগমন ও বক্তৃতা করেন, যা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
চট্টগ্রাম কলেজ এর ইতিহাস
ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তিন কালের সাক্ষী ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারক এই চট্টগ্রাম কলেজ।
১৮৩৪ সালে লর্ড বেন্টিংয়ের শাসনামলে টমাস বেবিংটন মেকলকে সভাপতি করে গঠিত হয় জনশিক্ষা সাধারণ কমিটি।
এই কমিটির সুপারিশে ১৮৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রাম জিলা স্কুল হিসেবে উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৩৩ বছর পর ১৮৬৯ সালে পূর্বোক্ত জিলা স্কুলে এফএ (বর্তমান উচ্চমাধ্যমিক) ক্লাস চালুর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম কলেজ।
কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন মি. জে.সি বোস। কিন্তু এক বছর চলার পরেই অর্থাভাবে কলেজের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
১৮৭১ সালে মিরেরসরাই থানার ধুম নিবাসী রায় বাহাদুর গোলকচন্দ্র রায়ের দশ হাজার টাকা অনুদানে এটি পুনরায় চালু হয়।
শুরুতে এখানে এফ.এ (ফার্স্ট আর্ট) শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান হতো। এর সঙ্গে ছিল প্লিডারশিপ পরীক্ষার জন্য আইন শিক্ষার ব্যবস্থা।
১৯০৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগ খোলা হলে কলেজে আইন শিক্ষার ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়।
১৯১০ সালে জিলা স্কুলকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজে ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়।
এ সময় গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞানে অনার্স পড়ানোর অনুমোদন পাওয়া যায়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর চট্টগ্রাম কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত হয়। ১৯২৪ সালে কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজে প্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ।
তাঁর সময়ে কলেজে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ কার্য সাধিত হয়—১. ছাত্রী ভর্তি কার্যক্রম অর্থাৎ সহশিক্ষা চালু, ২. কলেজবার্ষিকী প্রকাশ করা।
১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে কলেজের ব্যাপক হারে অবকাঠামোগত পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করা হয়।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধীনে এর বিজ্ঞান গবেষণাগারের উন্নয়ন সাধন, নতুন প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, নতুন ছাত্রাবাস নির্মাণ এবং পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান অনুষদের জন্য আলাদা ভবন নির্মাণ করা হয়।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি): অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাতন্ত্র্য
- চুয়েট: যেখানে ডানা মেলে হাজারও শিক্ষার্থীর স্বপ্ন
- চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ: মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক
চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম মুসলিম অধ্যক্ষ শামসুল ওলামা কামাল উদ্দিন ১৯২৬ সালে কলেজের প্রথম ছাত্রাবাস শেরেবাংলা একে ফজলুল হক মুসলিম হোস্টেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
১৯৫৫ সালে স্নাতক শ্রেণির সব বিষয় প্রত্যাহার করা হলেও ১৯৬০ সাল থেকে আবার ইংরেজি, বাংলা, অর্থনীতি, পদার্থ, রসায়ন এবং গণিতে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির বিষয়গুলো চালু করা হয়।
১৯৬২ সাল থেকে প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণি চালু করা হয়। বর্তমানে মানবিক এবং বিজ্ঞান বিষয়ে ২০টি বিভাগ রয়েছে অধ্যয়ন করার জন্য।
অবকাঠামো ও অনুষদ এবং বিভাগ
বর্তমানে চট্টগ্রাম কলেজ চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধীনে উচ্চমাধ্যমিক সনদের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, গণিত, পরিসংখ্যান, ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান এবং সনদ প্রদান করে থাকে।
প্রতিদিন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এবং স্বনামধন্য এ চট্টগ্রাম কলেজ।
প্রায় ১৮ হাজার থেকে ২০ হাজার শিক্ষার্থী, ১৭টি অনার্স, ১৮টি মাস্টার্স বিষয়সহ ডিগ্রি (পাস) ও উচ্চমাধ্যমিক কোর্সে অধ্যয়নরত।
কোর্স অন্তভুক্তিকরণ
- এস এস সি ১৮৩৬ সালে
- ডিগ্রী (পাস) ১৯১০ সালে
- স্নাতক ১৯১৯ সালে
- মাস্টার্স প্রিলিমিনারি ১৯৯২ সালে
- মাস্টার্স ফাইনাল ১৯৯২ সালে
অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষসহ কলেজের ১৫৭ শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান করছেন। এছাড়া দেড় শতাধিক তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কাজ করে চলেছেন এ কলেজে।
প্রতি বছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এ স্বপ্নের কলেজে লেখাপড়ার করা জন্য।
কলেজের অভ্যন্তরেই আছে বিশালাকৃতির ঐতিহাসিক প্যারেড মাঠ। মাঠের এক কোণে আছে একটি জিমনেসিয়াম, শিক্ষার্থীদের আবাসিক ভবনগুলোর মধ্যে আছে তিনটি ছাত্রাবাস এবং দুটি ছাত্রীনিবাস।
এগুলো হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাস, শের এ বাংলা ছাত্রাবাস, ড. আবদুস সবুর ছাত্রাবাস, হজরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) ছাত্রীনিবাস এবং নতুন একটি ছাত্রীনিবাস নির্মাণ করা হয়েছে, যার নামকরণ করা হবে ‘শেখ হাসিনা’ ছাত্রীনিবাস।
বর্তমানে প্রশাসন সব আবাসিক হোস্টেল বন্ধ রেখেছে।
চট্টগ্রাম কলেজ স্বনামধন্য গ্রন্থাগারটিও ঐতিহ্য বহন করে। এ গ্রন্থাগারে সংগৃহীত বানিয়ানের পিলগ্রম প্রগ্রেসের এক কপি বই থেকেই পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে এ গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা অর্ধ লক্ষাধিক।
গৌরবের ১৫০ বছর
হাটি হাটি পা পা করে সুদীর্ঘ দেড়শ বছর অতিক্রম করছে চট্টগ্রাম কলেজ। ১৮৪১ সালে স্থাপিত ঢাকা কলেজের পর এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় কলেজ।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কলেজ ২০১৯ সালে পদার্পণ করেছে ১৫০ বছরে।
গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য নিয়ে ১৫০ বছর ধরে এ প্রতিষ্ঠান জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। পেয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চারবার দেশসেরা কলেজের স্বীকৃতি।
‘শিক্ষাই শক্তি’। এই প্রেরণা ও প্রতিপাদ্য ধারণ করে ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাঙ্গন চট্টগ্রাম কলেজ।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
- কর্ণফুলী নদী: হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের অমর সাক্ষী!
- ভাসানচর: আমূল বদলে যাওয়া এক দ্বীপের গল্প!
দেড়শ বছরের গৌরবময় এই শিক্ষাঙ্গণ সৃজন করেছে অগণিত জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধক, গুণীজন, সমাজ হিতৈষীসহ হরেক ক্ষেত্রে সফল পেশাজীবী।
যারা দেশে ও বিদেশে আজো সুপ্রতিষ্ঠিত।
চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থীরা মেধা আর মননে নিজেদের অনন্য হিসেবে অবদান রেখে চলেছেন। তারা এই কলেজের নামের সঙ্গে নিজের নামকে সগৌরবে যুক্ত করে পরিচয় বহন করছেন।