অলি খাঁ মসজিদ ( ওয়ালী খান মসজিদ) মোগল আমলের ঐতিহ্য ও প্রায় ৩০৫ বছরের পুরানো জামে মসজিদ। জানা ইতিহাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে মোগলদের প্রভাব লক্ষনীয়। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
এককালের প্রতাপশালী মোঘলরা আজ জীবিত নেই। উপমহাদেশে মোঘল সূর্যাস্ত হয়েছে কয়েকশত বছর হয়ে গেল।
পৃথিবীখ্যাত সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, শাহজাহান, আওরঙ্গজেবদের বিশাল সাম্রাজ্য কালের বিবর্তনে বিলীন হয়ে গেছে।
তবে সেদিনের সম্রাট, সাম্রাজ্য, ক্ষমতা হারালেও মোঘলদের ছাপ উপমহাদেশ থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি।
অধুনা বাংলাদেশে মোঘলদের কীর্তি যুগ যুগ ধরে টিকে আছে।
চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। জানা ইতিহাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে আরাকানী মঘীদের পাশা-পাশি মোগলদের প্রভাব লক্ষনীয়। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
মুঘল স্থাপত্য
উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলজুড়ে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ১৫২৬ সালে পানিপথের যুদ্ধে বাবরের বিজয়ের পরে মুঘল রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মুঘল স্থাপত্য ইসলামি, পারস্য ও ভারতীয় স্থাপত্যের এক সংমিশ্রণ।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রসারিত মুঘল সাম্রাজ্যে এই স্থাপত্যশৈলীটি বিকশিত হয়ে ওঠে।
মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অনেক নিদর্শন ভারত, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে দেখতে পাওয়া যায়।
অলি খাঁ মসজিদ নির্মাণ
মোগল আমলের ঐতিহ্য ও প্রায় ৩০৫ বছরের পুরানো চট্টগ্রাম শহরে চকবাজার এলাকায় অবস্থিত ওয়ালী খান মসজিদ, যা ‘অলি খাঁ মসজিদ’ নামে সমধিক পরিচিত।
চট্টগ্রামের মোগল ফৌজদার ওয়ালী বেগ খাঁ ১৭১৩ হতে ১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
তখন পর্যন্ত পারস্য, স্পেন, মোগল সাম্রাজ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলের ইসলামী স্থাপত্য আর সৌন্দর্যের যে বিকাশ তার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে এ মসজিদের নির্মাণে।
ওয়ালী বেগ খাঁ চকবাজারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
আবদুল হক চৌধুরীর লেখা ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেখা যায়, এ মসজিদের খরচ নির্বাহের জন্য অলিবেগ খাঁ রাউজান থানার কদলপুর, মিরসরাইয়ের নিজামপুর ও সন্দ্বীপে ১২০ দ্রোন জমি ওয়াকফ করে গেছেন ।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ: মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক
- কদম মোবারক মসজিদ: ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নিদর্শন
- চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ: ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন
ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদসংলগ্ন এলাকা ছিল চট্টগ্রামের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র চকবাজার।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এ মসজিদের পূর্ব দিকে শানবাঁধানো দিঘিটি কমলদহ দিঘি নামে পরিচিত ছিল ।
বর্তমানে দিঘিটি ভরাট করে কিশলয় কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হয়েছে । আর দিঘির পাড়ে ছিল অলিবেগ খাঁর কাচারি ।
তিনি কাচারিতে থেকে নবাবি কাজ চালাতেন ।
সেই সময়ে শুলকবহর পর্যন্ত বাণিজ্যের জাহাজগুলো যাতায়াত করত এবং সে জন্য তিনি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে এখানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা পরে চকবাজার নাম ধারণ করে ।
বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এ এলাকায় আসা মানুষের নামাজের জন্য তিনি এ মসজিদ নির্মাণ করেন ।
কমলদহ দিঘি থেকে অজু করে মুসল্লিরা এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে আসতেন । আর মসজিদের পূর্ব দিকের প্রবেশপথটি ছিল অপূর্ব ।
মূল্যবান দ্রব্যাদি ব্যবহার, অলঙ্করণ, কারুকাজ, সাজসজ্জা আর সৌন্দর্যের দিক দিয়ে মোগল আমলে নির্মিত মসজিদের মধ্যে এ মসজিদ অন্যতম।
স্থাপত্যশৈলী
চট্টগ্রামে মুঘল স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অলি খাঁ মসজিদ ( ওয়ালী খান মসজিদ)। অনিন্দ্য সৌন্দর্যে সজ্জিত এ মুসলিম স্থাপনার আসল সৌন্দর্য বাহির থেকে তেমনটা বোঝা যায় না।
তবে ভেতরের অংশটা অনেক চমকপ্রদ। মুল মসজিদের দেয়ালগুলো অনেক পুরু।
দেয়ালের পুরত্ব প্রায় ১ থেকে ৩ ফুট পর্যন্ত। দেয়ালের গায়ে রয়েছে ছোট ছোট খোপ।
যেগুলোতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হতো বলে ধারনা করা হয়। বর্তমানে এই খোপগুলোতে পবিত্র কোরআন শরীফসহ বিভিন্ন জিনিস রাখা আছে।
অলি খাঁ মসজিদ জন্য নির্ধারিত জায়গা প্রায় ১৮ শতক। তবে মুল মসজিদটি নির্মিত হয়েছে প্রায় ৬ থেকে ৭ শতক জায়গার উপর।
মুল মসজিদের রয়েছে বিশাল বিশাল ৬টি গুম্বুজ (চারটি বড় এবং দুইটি ছোট)। এই গুম্বুজগুলোই মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।
দু আইল বিশিষ্ট আয়তাকার মসজিদটির বাইরের কোণাগুলিতে সংযুক্ত চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ রয়েছে। এর পূর্বদিকে তিনটি প্রবেশপথ আছে।
এগুলির মাঝেরটি একটি আয়তাকার ফ্রোন্টনের (কারুকার্যখচিত অংশ) মধ্যে স্থাপিত এবং এটি পার্শ্ব প্রবেশপথ দুটি অপেক্ষা বড়।
চকবাজারমুখী ফ্রোন্টনটি তৎকালীন মুগল শহরের জাঁকজমক বৃদ্ধি করেছে।
মসজিদের অভ্যন্তরভাগের দৈর্ঘ্য ১৭.৬৪ মিটার এবং প্রস্থ ১০.২১ মিটার। অন্যান্য ভারবহনকারী দেওয়াল সংলগ্ন স্তম্ভ ও খিলানগুলিসহ ইটের তৈরি শক্ত দুটি স্তম্ভ প্রার্থনা কক্ষটিকে তিনটি ‘বে’ তে বিভক্ত করেছে।
এর প্রতিটি ‘বে’র ছাদ দুটি গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। এভাবে উক্ত ‘বে’গুলির উপর একই রকমের ছয়টি ফাঁকাগম্বুজ দেখা যায়।
প্রতি সারিতে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। প্রতিটি গম্বুজ অষ্টকোণাকৃতির পিপার উপর স্থাপিত।
এগুলির শীর্ষভাগ বহুস্তর বিশিষ্ট চূড়া দ্বারা পরিশোভিত। কিবলা দেওয়ালে তিনটি মিহরাব আছে।
মাঝের মিহরাবটি ব্যাপক সংস্কার ও নতুন অলংকরণের ফলে তার আদি অলংকরণ মুছে গেছে।
কিন্তু কিবলা দেওয়ালের পেছন দিকে এর অভিক্ষেপটি এখনও লক্ষণীয়।
এ বিশাল মসজিদ পরবর্তীসময়ে ব্যাপক সংস্কারের ফলে তার অনেক অতীত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে।
উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দেওয়াল বর্তমানে সংযোজিত বারান্দার পেছনে ঢাকা পড়ে গেছে এবং মসজিদের ঐতিহ্যপূর্ন অবয়ব বাইরে থেকে আর দেখা যায় না।
এদিকে, দীর্ঘদিন অবহেলা আর অযত্নে থাকার পর ২০১০ সালে মসজিদটি ভেঙ্গে পুনরায় নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয় স্থানীয় কিছু লোকজন।
পরে মুল মসজিদটি ভেঙ্গে নতুন মসজিদ গড়ার বিরোধিতা করেন কিছু সচেতন ব্যক্তি।
তারা বলেন মুল মসজিদটি যেহেতু মুঘল আমলের স্থাপনা, এটি মুসলমানদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মসজিদ।
তাই মুল মসজিদটি না ভেঙ্গে সামনের খালী জায়গায় নতুন করে মসজিদের ভবন নির্মান করার পরামর্শ দেন তারা।
অনেক দ্বন্দ্ব ও কানা ঘষার পরে ২০১১ সালে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসে তখন তিনি মসজিদটি না ভেঙ্গে সংস্কারের পরামের্শ প্রদান করেন স্থানীয় প্রশাসনকে।
মসজিদের পুনর্নির্মাণ
দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলীর ‘অলি খাঁ মসজিদ’ পুরাতন অবকাঠামো অক্ষুণ রেখে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রতি ফ্লোর পাঁচ হাজার বর্গফুট হিসাবে ছয় তলার সর্বমোট ৩০ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই মসজিদ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা।
এতে চার হাজার মুসল্লি এক সাথে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
নিজস্ব অর্থায়নে মসজিদ পুনর্নির্মিত হচ্ছে। এতে থাকছে দুইটি লিফট, দুইটি সিঁড়ি, ৮৫ ফুটবিশিষ্ট সুউচ্চ একটি মিনার, কারপার্কিং ব্যবস্থা, টয়লেট, ওজুখানা, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও অফিস কক্ষ এবং পাঠাগার ইত্যাদি।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- হাটহাজারী মাদ্রাসা: উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কওমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
- বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার: ‘বোস্তামীর কচ্ছপ’ পৃথিবীতে বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রাণী
- পরীর পাহাড়ে চট্টগ্রাম আদালত ভবন, অনন্য স্থাপত্যকীর্তি!
চট্টগ্রামে প্রাচীন মুসলিম স্থাপনার মধ্যে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ (১৬৬৯), নবাব ইয়াসিন খান নির্মিত কদম মোবারক মসজিদ (১৭১৯), নবাব ওয়ালী বেগ খান নির্মিত অলি খাঁ মসজিদ (১৭১৩), হামজা খাঁ মসজিদ, হাটহাজারী (১৬৮২), রাস্তি খাঁ মসজিদ (১৪৭৪) নসরত বাদশা মসজিদ (১৫৬৭) সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সময়ের ও কালের ঐতিহ্য এ মসজিদের মধ্যে অনেকগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। মাত্র কদম মোবারক মসজিদটি, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ ও নবাব ওয়ারী বেগ খাঁর অলি খাঁ মসজিদ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।