শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ও সৃজনশীল চর্চার অন্যতম ক্ষেত্র চট্টগ্রামের ‘চেরাগী পাহাড়’ মোড়। প্রাচ্যরাণী চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে চেরাগী পাহাড়ের প্রাচীন ইতিহাস জড়িত।
কিংবদন্তি আছে, বদর শাহ নামের একজন পীর প্রথম চেরাগ জ্বালিয়ে দেও, দৈত্যদানোয় ভরা এই শহর থেকে দূর করেছিলেন অশুভ আত্মা।
আর যে পাহাড়ের ওপর তিনি চেরাগ জ্বালিয়েছিলেন তার নাম হয়েছিল চেরাগী পাহাড়।
তবে কেউ যদি এই গল্প শুনে চেরাগী পাহাড় খুঁজতে বের হন তিনি হতাশই হবেন। কেননা ওখানে কোনো পাহাড়ই নেই, শুধু সারি সারি দালান।
‘চেরাগী পাহাড়’ -এর মতো চট্টগ্রাম নগরের আরও বহু এলাকার সঙ্গে পাহাড় নামটি থাকলেও বাস্তবে সেখানে এখন পাহাড়ের ছিটেফোঁটাও নেই।
মানুষ কথায় বলে- বাতির নীচে অন্ধকার তাই আমরা চেরাগের আলো থাকার পরও চেরাগী পাহাড়কে চিনিনা-জানিনা, তবে এখন সেই সবুজ অরণ্য ভরা উচু পাহাড় নেই, আছে শুধু কৃত্রিমভাবে বানানো একটি চেরাগ- এই চেরাগ কিন্তু আলউদ্দিনের সেই অলোকিক চেরাগ নয়!
প্রাচ্যরাণী চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে চেরাগী পাহাড়ের প্রাচীন ইতিহাস জড়িত। ‘চেরাগী পাহাড়’ এর ইতিহাস ঐতিহ্য আজ হারাতে বসেছে।
প্রতিদিন শত শত সংবাদ ও সংস্কৃতি কর্মীদের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হলেও তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যে রক্ষার বিষয়ে সবাই কেন যেন নিরব !
পত্রিকা ও ডাক্তার পাড়া নামে খ্যাতি অর্জন করলেও এই চেরাগী পাহাড়ের একটি গৌরব গাথা ইতিহাস রয়েছে, সেই ইতিহাসকে ভবিষৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হলে চেরাগী পাহাড়ের পাহাড়ি রূপ পর্যালোচনা করার দরকার।
কথিত আছে , সুদূরে অতীতে আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে বদর শাহ নামক একজন সুফি সাধক ভাসমান একখণ্ড পাথরের উপর আরোহণ করে পূর্ব দেশে রওনা হন।
তারপর একদিন পাথরখণ্ডটি বদর শাহকে নিয়ে কর্ণফুলি নদীতে প্রবেশ করে এবং নদীর যে স্থানে পাথরটি থেমে যায় সেইস্থানে তিনি নেমে যান।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রাম আদালত ভবন: পরীর পাহাড়ে অনন্য স্থাপত্যকীর্তি!
- ইতিহাসের সাক্ষী চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি: নির্মল ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে ৭৩১ যোদ্ধা
- কর্ণফুলী নদী: হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের অমর সাক্ষী!
পরবর্তীকালে বদর শাহকে বহনকারী পাথরের স্মারকরূপে সে স্থানটি ‘পাথরঘাটা’ নামে খ্যাত হয়। তখন সমগ্র চট্টগ্রাম শহর ছিল জনমানবহীন গভীর অরণ্যে আবৃত।
সেখানে ছিল জ্বীন-পরীর আবাসস্থল। বদর শাহ একটি মাটির চেরাগ হাতে নিয়ে পাথরখণ্ড থেকে নেমে তীরে উঠে গভীর বন-জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একটি পাহাড়ের উপর উঠলে জ্বীন-পরী তাঁকে বাধা দান করে।
তারা বলে যে, কে আপনি আমাদের মুল্লুকে অনধিকার প্রবেশ করেছেন ? এখানে কোন মানুষের স্থান হবে না।
তখন বদর শাহ বলেন যে, আমি একজন সংসারবিরাগী বৃদ্ধ।
আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী (উপাসনা) করার মানসে এখানে এসেছি। আমাকে এখানে থাকবার স্থান দাও।
কিন্তু জ্বীন-পরীরা কোনমতে তাঁকে স্থান দিতে সম্মত হয় না। তাদের কথা কাটাকাটির মধ্যে রাত্রি হয়ে যায়।
তখন বদর শাহ রাতের অন্ধকারে চেরাগটি রেখে জ্বালাবার স্থানটুকু দিতে বলেন। জ্বীন-পরীরা শেষ পর্যন্ত চেরাগ রাখার স্থানটুকু দিতে সম্মত হয়।
তিনি হাতের চেরাগ পাহাড়ের উপর রাখলেন এবং নিজের আলখাল্লার জেব (পকেট) থেকে দুটি চকমকি পাথর বের করে একটার সাথে আর একটা ঘষে আগুন বের করে চেরাগ জ্বেলে দিলেন।
দেখতে দেখতে চেরাগের রোশনাই (আলো) উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হতে থাকে।
কিন্তু সে রোশনাই থেকে এমন এক তীব্র তেজ বিকিরণ করতে থাকে যে চট্টগ্রামে বসবাসকারী সমস্ত জ্বীন-পরীরা শরীরে এক তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।
কিন্তু সেজন্য তারা কোন প্রতিবাদ বা প্রতিকার করতে পারল না।
যেহেতু তারা বদর শাহকে চেরাগ রাখার স্থান দিতে পণবদ্ধ হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বদর শাহর অলৌকিক চেরাগের আলোর তেজ সহ্য করতে না পেরে জ্বীন-পরী চিরতরে চট্টগ্রাম পরিত্যাগ করে চলে যায়। চট্টগ্রাম আবাদ হয়।
বদর শাহর চেরাগ রাখার পাহাড় ‘চেরাগী পাহাড়’ নামে খ্যাত হয়। আজো চেরাগী পাহড়ে হিন্দু-মুসলিম অধিবাসীরা মানত করে মোমবাতি জ্বালায়।
পথচারীরা জানায় সালাম। কিন্তু কিংবদন্তী ইতিহাস নয়- চেরাগী পাহাড় নামের এই উৎস ইতিহাস হতে পারে না।
ঐতিহাসিক যুগের প্রারম্ভকাল থেকে চট্টগ্রাম প্রায় হাজার বছর কাল আরাকান অধিকারভুক্ত ছিল।
চট্টগ্রামের ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতিতে আরাকানি প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি চেরাগী পাহাড় নামেরও একটি আরাকানি উৎসের সন্ধান পাওয়া গেছে।
জানাযায়, নগরের একটি বিখ্যাত পাহাড়ের চূড়ায় ছিল চাকমা রাজার ভবন। সেখানে বসত গানের আসর। তা নিয়ে নানা উপকথাও তৈরি হয় লোকমুখে।
স্থানীয় লোকজন বলতেন, সেই পাহাড়চূড়ায় পরিরা গান গায়, নেচে বেড়ায়। এমন কাহিনির সূত্র ধরে পাহাড়টির নাম হয়েছিল পরীর পাহাড়।
ইংরেজদের কাছে ফেয়ারি হিল নামে পরিচিত এই পাহাড়ে ব্রিটিশ আমলেই চট্টগ্রাম বিভাগ ও জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
এখানকার আদালত ভবনটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু কালে কালে সংকুচিত হয়ে পড়েছে ‘পরীর পাহাড়’।
পরীর পাহাড়ের পশ্চিম-উত্তরাংশের নাম ছিল টেম্পেস্ট হিল। এই পাহাড়ের মালিক ছিলেন হ্যারি নামের এক পর্তুগিজ। পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার এটিকে হুকুম দখল করে কালেক্টরের বাসভবন নির্মাণ করেন।
বর্তমানে কালেক্টরের বাসভবনসহ গোটা টেম্পেস্ট হিলটাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
টেম্পেস্ট হিলের পূর্বে ও পরীর পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি অনুচ্চ পাহাড়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের অফিস ও বাংলো ছিল। এটিও কেবল নামেই আছে।
রেডিও বাংলাদেশ চট্টগ্রামের পাহাড়িকা অনুষ্ঠানের তৎকালীন সহকারী উপ-প্রযোজক আরাকানি ভাষী মিষ্টার উ-চ-নু ও অধ্যাপক মং উসাং২ এর মতে, চট্টগ্রাম শহরের চেরাগী পাহাড় নামটি আরাকানি নামের অপভ্রংশ। আরাকানি ভাষায় এ নামটি ‘চারেগ্রীটং’।
‘চারেগ্রী’ ও ‘টং’ এ দুটি শব্দ যুক্ত হয়ে চারেগ্রীটং নামের উৎপত্তি। ‘চারেগ্রী’ অর্থ প্রধান হিসাবরক্ষক। ‘টং’ অর্থ পাহাড়। প্রধান হিসাবরক্ষকের পাহাড়।
চট্টগ্রাম আরাকানি শাসনকালে সম্ভবত চট্টগ্রাম শহরের এই পাহাড়টিতে তাদের প্রধান হিসাবরক্ষক বা দেওয়ানের চারেগ্রীর বাসস্থান ছিল বলে পাহাড়টিকে চট্টগ্রামের অধিবাসীরা চারেগ্রী পাহাড় নামে খ্যাত করে। কালক্রমে চারেগ্রী পাহাড় নামটি অপভ্রংশ হয়ে চেরাগ্রী পাহাড়, অবশেষে চেরাগী পাহাড় রূপ প্রাপ্ত হয়েছে।
চট্টগ্রামে মুসলমান বিজয়ের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানতে পারা যায়, যে সোনারগাঁর সুলতান ফকরউদ্দিন মুবারক শাহর আমলে (১৩৩৮-১৩৫০ খ্রি.) ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে আরাকানিদের বিতাড়িত করে চট্টগ্রামকে প্রথম সোনারগাঁর মুসলমান রাজ্যভুক্ত করা হয়।
১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর পরিব্রাজকে ইবনে বতুতা চট্টগ্রাম আগমন করেন। তিনি ভ্রমণকাহিনীতে সুলতান অধিকৃত চট্টগ্রামের শাসনকর্তা শায়েদা সুলতানের পুত্রকে হত্যা করার ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন।
কিন্তু বদর শাহের অলৌকিক চেরাগের আলোর তেজে জ্বীন-পরী বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম বিজয়ের কথা লিখেন নি।
কবি মোহাম্মদ খাঁ বিরচিত মক্তুল হোসেন কাব্যে (১৩৪৬ খ্রি.) বর্ণিত আত্মকথার পিতৃকুল পরিচিতিতে বর্ণনা করেছেন, সেনাপতি কদল খান গাজী মগদের বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম জয় করেন। এবং মগদের চাটশ্বরী মন্দির ধ্বংস করেন।
বদর শাহ চট্টগ্রাম বিজয়ে কদল খান গাজীকে সহায়তা দান করেন।
এ সময় কবির আদিপুরুষ মাহি আসোয়ার ও হাজী খলিল পীর সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে আগমন করেন ইত্যাদি। কবি মোহাম্মদ খান সেনাপতি কদল খান গাজীকে বদর শাহ কর্তৃক সহায়তা করার কথা লিখেছেন।
বদর শাহর অলৌকিক চেরাগের আলোর তেজে জ্বীন-পরী বিতাড়নের কথা লিখেন নি। সুতরাং নির্দ্বিধায় বলা যায় যে বদর শাহর অলৌকিক চেরাগ ও জ্বীন-পরীর কিংবদন্তী একটি আষাঢ়ে গল্প।
মুসলমানদের পতন যুগে কোন সুযোগসন্ধানী এ যুগের লালসালু ঘেরা দিয়ে রাতারাতি দরগাহ স্থাপনের মত চেরাগী পাহাড়েও স্থাপন করেছিল বদর শাহর বাতি জ্বালানোর স্মারক নিদর্শনাদি। তারি শিকার হয়েছিল এদেশের ধর্মভীরু ও অশিক্ষিত অধিবাসীরা।
আজকের সময়ে চেরাগী পাহাড়
ভোর পাঁচটা থেকে ছ`টার মধ্যে ঢাকার দৈনিক পত্রিকাগুলোর গাড়ী গিয়ে হাজির হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পত্রিকাগুলোও ততোক্ষণে ছাপাখানা থেকে বের হয়ে এসে হাজির হয় চেরাগীতে।
হকার অফিসগুলোর সামনে শুরু হয় হকারদের ব্যস্ততা।
গরম গরম পত্রিকাগুলোর মৌ মৌ সৌরভে তখন মুখরিত চেরাগীমোড়। শুধু খবরের উত্তেজনা নয়, এক সদ্য ছাপা হওয়া সংবাদপত্রের সুগন্ধ এক মনমাতানো পরিবেশ সৃষ্টি করে। শুরু হয় হকারদের ছুটে চলা।
সাইকেলের পেছনে পত্রিকা বেঁধে টুং টাং শব্দ করে যখন হকাররা ছুটে চলে তখন নগরে ঘোষিত হয় নতুন বারতা।
এছাড়া চেরাগী পাহাড় মোড় বললেই চোখের সামনে ভেসে উঠে অসংখ্য দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের অফিস। পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর প্রকাশনা সংস্থা, মুদ্রণ, হকার সমিতির কার্যালয়।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- আন্দরকিল্লা মসজিদ: মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক
- কালুরঘাট সেতু: ঐতিহ্যের স্মারক হালুরঘাডর পোল!
- ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিল: চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার
মূলত চেরাগী মোড়কে কেন্দ্র করেই চেরাগী মোড়, আন্দরকিল্লা মোড় থেকে কাটা পাহাড়, চন্দনপুরা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে বিশাল ছাপা খানার বাজার।
যেখানে সকাল সাতটা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছাপা খানার মেশিন ঘুরতে থাকে।
চেরাগী মোড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান, ব্যান্ড দল, ব্যাংক-বীমা, অ্যাডফার্ম, স্টেশনারি, কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র, হাসপাতাল, মন্দির, হল সর্বোপরি সকল প্রকার বাণিজ্যিক, সমাজকল্যাণমূলক ও শিল্প সাহিত্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান।
প্রতিদিনই এখানে ছুটে আসছে শহর বন্দর গ্রামগঞ্জ হতে শত শত হাজার হাজার মানুষ।
বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামের অন্যতম এ চেরাগী পাহাড়ে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে কোটি কোটি টাকার। ঢাকার পরেই প্রকাশনা বাজারের দিক থেকে চট্টগ্রামের অবস্থান দ্বিতীয় যা চেরাগীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।