গুমাই বিল, চট্টগ্রামের শস্যভাণ্ডার খ্যাত প্রায় তিন হাজার হেক্টর আয়তনের চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বিখ্যাত একটি বিল। এই বিলের এক মৌসুমের উৎপাদিত ধান দিয়ে নাকি সারা দেশের আড়াই দিনের খাদ্যের চাহিদা মেটানো যায়!
প্রায় তিন হাজার হেক্টর আয়তনের দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধানের গোলাখ্যাত গুমাই বিল চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত।
রাঙ্গুনিয়ার নিশ্চিন্তাপুর পাহাড়ের পাদদেশে চন্দ্রঘোনা, মরিয়মনগর, হোসনাবাদ, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া, লালানগর ইউনিয়ন ও পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে যার অবস্থান।
দেশের বৃহত্তম চলন বিলের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাঙ্গুনিয়ার এই গুমাই বিলের মোট আবাদি জমির পরিমান ২ হাজার ৪’শ হেক্টর।
এই বিল রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মরিয়ম নগর থেকে শুরু হয়ে এ জমি শেষ হয়েছে রাঙ্গামাটির নিশ্চিন্তপুর গিয়ে।
আরেক অংশে রয়েছে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলা।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘গুমাই বিল’। এই বিল উৎপাদন ও অর্থনীতির গতি প্রবাহ চট্টগ্রামকে করেছে সমৃদ্ধ।
স্থানীয়দের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত আছে, এই বিলের এক মৌসুমের উৎপাদিত ধান দিয়ে নাকি সারা দেশের আড়াই দিনের খাদ্যের চাহিদা মেটানো যায়!
গুমাই বিলের জমিতে প্রতি বছরই হয় ইরি এবং আমনের বাম্পার ফলন। পাকিস্তান শাসনামলে এই বিলে শুরু হয়েছিলো ধান চাষ। আর স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো এখানে আধুনিক সেচের ব্যবস্থা করে।
সময় গড়ানোর সাথে সাথে বেড়েছে এর ব্যাপকতা। স্থানীয় শত শত কৃষকের জমি রয়েছে এখানে।
এখানে পরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে কৃষি বিভাগ।
স্থানীয়রা জানান, গুমাই বিল একসময় ঝিল ছিল। এ বিলজুড়ে ছিল মাছ আর মাছ। আর নানা প্রজাতির পাখপাখালিতে ভরপুর। এখন এগুলো শুধুই স্মৃতি।
গুমাইয়ের সাথে রাঙ্গুনিয়াবাসীর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।
গুমাই এক সময় ঝিল আকারে থাকলেও রাঙ্গুনিয়ার উপর দিয়ে বয়ে চলা কর্ণফুলী নদী এবং গুমাইয়ের কুলে নেমে আসা প্রচুর পাহাড়ী ঝর্ণা, ছড়া ও ঝর্ণাবাহিত পলি এবং পলি বালি মিশ্রিত স্রোতধারা পরিকল্পিতভাবে প্রবাহের ব্যবস্থা করে রেখেছে গুমাইয়ের বুকে।
বাইনালার ছড়া, সোনাইছড়ি, মুন্দরী, কুরমাই, ইছামতি, বারঘোনিয়া, ঘাগড়া হ্রদ খাল ও গুট্টাকার খাল গুমাইতে প্রবাহিত হয়।
ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিল
চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন প্রবাদ- “হাতত কাঁচি কোঁরত দা, ভাত হাইলি রইন্ন্যা যা” অর্থাৎ যদি ভাত খেয়ে বাঁচতে চাও তাহলে একখানা ধান কাটার কাঁচি ও কোমরে একখানা দা নিয়ে রাঙ্গুনিয়া যাও।
এই প্রবাদের মধ্যে দিয়ে রাঙ্গুনিয়ার স্বনির্ভরতা ও গৌরবের ইতিহাস প্রকাশ পায়।
চট্টগ্রাম জেলার শস্য ভান্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিল মূলত কর্ণফুলী নদী বিধৌত উর্বর ভূমি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধানের গোলা খ্যাত গুমাই বিল উৎপাদন ও অর্থনীতিকে করছে সমৃদ্ধ।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- পরীর পাহাড়ে চট্টগ্রাম আদালত ভবন, অনন্য স্থাপত্যকীর্তি!
- কিংবদন্তির ‘চেরাগী পাহাড়’ আছে কেবল নামেই
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
অতীত এই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিল। ধানের জমি দখল করে তোলা হচ্ছে বসতবাড়ি।
এছাড়া, বর্তমানে প্রধান সড়ক সংলগ্ন জমি ভরাট করে তোলা হচ্ছে নানা স্থাপনা।
এমনকি ইট ভাটাও তৈরি হয়েছে এখানে। এ অবস্থায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী এই বিল।
সাদা বকের আনাগোনা
‘চাষাবাদের জন্য বিলে পানি দেওয়ার পর সাদা বক পোকা-মাকড় খেতে ছুটে আসে। স্থানীয় ভাষায় এসব বক পাখিকে ধলা বোঘা বলে।’
তখন শত শত সাদা বকের দেখা মিলে। মনে হচ্ছে বকের অভয়াশ্রম।
প্রতিদিন সকাল হতে বিলে খাবারের সন্ধানে ছুটে আসে হাজার হাজার বক পাখি। যতদূর দৃষ্টিসীমা ঘিরে ফেলছে এক ঝাঁক সাদা বক।
আবার কখনও চোখের নিমিষে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে দৃষ্টিসীমানার বাইরে। এই যেন এক অপূর্ব দৃশ্য!
চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা-কদমতলী ইউনিয়নের আধুর পাড়া অংশে গুমাই বিলে গেলে এই দৃশ্য দেখা যায়।
কাছে যেতেই উড়ে যাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে এসব বক। এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য না দেখলে বোঝা যাবে না।
প্রতি বছর ইরি এবং আমন ধানের মৌসুমে চাষাবাদের জন্য বিলে পানি সেচ দেওয়ার স্থানে খাবারের জন্য বিচরণ করতে আসে এসব বক।
কিন্তু কিছু মানুষের লোভের কারণে সেগুলো বিপন্ন হতে বসেছে।
স্থানীয়দের মতে, গেল বছরও এত বক পাখির দেখা মেলেনি। কেউ কেউ পাখি শিকারের চেষ্টা করলেও স্থানীয়দের প্রতিরোধে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে।
বিকেল হলেই ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি
স্থানীয়রা কৃষকরা জানান, গুমাই বিলে টিয়া পাখিরা বিকেল হলেই দলবেঁধে বসে ধান খেয়ে ফেলে।
এ জন্য দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত পালাক্রমে ধান জমি পাহারা দিতে হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানান, ধান খেয়ে ফেলা ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি তাড়ানো ছাড়া অন্যকোনো পদ্ধতি নেই।
কারণ পাখি তো কীটনাশক দিয়ে হত্যা করা যাবে না।
সর্বনাশা ইটভাটা
দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বিল গুমাই’র আয়তন একটু একটু করে কমছে। এর সঙ্গে হালে যোগ হয়েছে কালো থাবা। ঐতিহ্যবাহী এই বিলে গড়ে উঠেছে সর্বনাশা ইটভাটা।
ভাটায় মাটির জোগান দিতে প্রতি বছর কেটে নেয়া হচ্ছে গুমাই বিলের ফসলি জমির টপ সয়েল।
কোথাও কোথাও জমি কিনে বিশালাকারের পুকুর করে খুঁড়ে নেয়া হচ্ছে মাটি।
অন্যদিকে, এসব ইটভাটার মাটি-জ্বালানি আসে আবার রাঙ্গুনীয়ার পাহাড়ি এলাকা থেকে।
ফলে একদিকে যেমন পাহাড়-বন ধ্বংস হচ্ছে, অপরদিকে উর্বরতা হারাচ্ছে জমি।
টপ সয়েল হারানো ছাড়াও ইটভাটার কালো ধোঁয়াজনিত প্রতিকূল প্রভাবের শিকার হয় গুমাই বিলের প্রায় ৬ হাজার একর জমির আমন ও ইরি ধানের চাষাবাদ।
কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে গুমাই বিল
অব্যাহত বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে কাপ্তাই বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ছেড়ে দেওয়া পানিতে প্লাবিত হয় গুমাই বিল ।
কাপ্তাই লেকের সর্বোচ্চ পানির ধারণক্ষমতা ১০৯ এম এস এল।
অব্যাহত বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে পানির এ উচ্চতা ছাড়িয়ে লেকের পানি বিপজ্জনক উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়ার পর লেক থেকে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চন্দনাইশের পেয়ারা: পথ দেখাচ্ছে স্বাদের ‘কাঞ্চন নগরের গয়াম’
- চুনতি অভয়ারণ্য: এশিয়ান হাতির প্রজননক্ষেত্র
- ফটিকছড়ির চা বাগান: সৌন্দর্য্যের আধার, উৎপাদনেও সেরা!
এর ফলে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়।
অনেক সময় পুরোপুরি পানির নিচে তলিয়ে যায় চট্টগ্রামের শষ্যভান্ডার খ্যাত গুমাই বিলের কমপক্ষে তিন হাজার একর জমির বীজ তলা ও ধান খেত।
গুমাইয়ের বুকে সোনালি উৎসব
গুমাইবিলে উঁকি দেয়া সোনালী ধানের ঝিলিক মারা হাসির মত আমনের ব্যাপক ফলনে কৃষকের মুখেও ফুটেছে হাসি।
চারদিকে পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধ বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে।
হালকা কুয়াশার পর্দা সরে গিয়ে মিষ্টি রোদ এসে পড়তেই দেখা গেল দিগন্তজোড়া প্রান্তরের সোনালি ঢেউ।
মৃদু বাতাসে পাকা ধানের শীষের দোলা বিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। এর মাঝেই দেখা গেল কাস্তে হাতে ব্যস্ত কৃষকদের।
বৃহত্তর গুমাই বিলে এখন সোনালি ধানের উৎসব চলছে। এখন বাম্পার ফলনের ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর কৃষকরা।
ধান কাটার বর্ণিল উৎসবে মাতোয়ারা কৃষাণ-কৃষাণী, দিনমজুর, গৃহস্থ সবাই।
বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে যেদিকে দু`চোখ যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে শুধুই শত শত কৃষকদের ধান কাটার দৃশ্য।
মাঝে মাঝে দূর বিল থেকে মাথায় কিংবা কাঁধে বোঝাই করে কৃষক নিয়ে আসছে কাটা ধানের বড় বড় আঁটি।
ধান কাটতে গিয়ে কিংবা কাটা ধান আনতে গিয়ে অনেক কৃষক গলা ছেড়ে গাইছেন গান। হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠছেন কৃষক, মজুর সবাই পরস্পরের সঙ্গে।
সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ এক দৃশ্য—যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এবার বিলের ৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়েছে।
প্রতি হেক্টরে এবার ধান হবে ৫ টন করে।
এই হিসাবে ধান হবে ১৫ হাজার ৭৫০ টন। প্রতি হেক্টরে এবার চাল হবে ৩ দশমিক ৩ টন করে। এই হিসাবে চাল হবে ১০ হাজার ৩৯৫ টন।
এদিকে গুমাই বিলে ধান কাটার উৎসবের সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকদের কদর।
গুমাই বিল থেকে ধান কাটা শেষ করে বাড়িতে ফেরার সময় যাতে বাড়তি কিছু উপার্জন করে নিয়ে যেতে পারেন, তার জন্য আছে শ্রমিকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা।
কিন্তু তাদের মনেও আছে হতাশা। তারা বলছেন, বর্ষাকালের চেয়ে শীতকালে বেশি মজুর আসে। সেজন্য তারাও সেভাবে বেশি মজুরি পাচ্ছেন না।
যত হতাশা আর আশংকা থাকুক না কেন, আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় কৃষকদের চোখে এখন কিলবিল করছে হাজারো স্বপ্ন। ঘরে ঘরে উৎসবের সোনালী আমেজ। যেন সোনালী ধানে নাচছে গুমাই, স্বপ্নভরা চোখে হাসছে কৃষক।
ছোট হয়ে আসছে গুমাই বিল
শস্যভান্ডার খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিল ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
এখানে জমি ভরাট করে গড়ে তোলা হচ্ছে বসতবাড়ি; নানা স্থাপনা। এমনকি ইটভাটাও হয়েছে। এর ফলে ছোট হয়ে আসছে এই বিল।
এই বিলের আয়তন চার হাজার হেক্টরের বেশি থাকলেও বর্তমানে তা কমে তিন হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে।
আবাদি এই বিলে অপরিকল্পিত আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের কারণে রাঙ্গুনিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।