চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলতে থাকা এক আলোকময় রথের যাত্রা। ১৯২৫ সালের পূর্বে কিছু কাল স্কুলটির নাম ছিল চট্টগ্রাম জিলা স্কুল।
চট্টগ্রামের প্রাচীনতম স্কুল ‘চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল’ ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। অবিভক্ত বাংলার সর্বপ্রথম সরকারি এই স্কুল চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের স্মারক।
বিজ্ঞান ও মানবিক শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে অগুনতি নাম যুক্ত হতে হতে শহীদ রফিকউদ্দিন সড়কে (আইসফ্যাক্টরি সড়ক) বাতিঘর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের লাল দালানটি।
যাদের নাম নিজের কালকে ছাড়িয়ে মহাকালে ছড়িয়ে পড়েছে, দেশ ছাড়িয়ে ভুবন জয় করেছে।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ১৯ শতকের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল কবি নবীন চন্দ্র সেন, দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম, ভারতীয় কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি জ্যোতিন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জাকির হোসেন, আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক হুওমায়ূন আহমেদ, নাট্যকার আবুল হায়াত।
এই নামের তালিকা যেমন সুদীর্ঘ, তেমনি উজ্জ্বল।
১৮৫ বছরের মহাযাত্রায় ইতিহাসের নানা বাঁকে, মানচিত্র ও রাজনীতির বহু পালাবদলেও কখনো ম্রিয়মাণ হয়নি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। নিজের ঔজ্জ্বল্যে সব সময় শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখে চলেছে।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি): অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাতন্ত্র্য
- চুয়েট: যেখানে ডানা মেলে হাজারও শিক্ষার্থীর স্বপ্ন
- চট্টগ্রাম কলেজ: সার্ধ-শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’-এর কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী তাঁর লেখা কবিতাটি প্রথম পড়েছিলেন ২২ ফেব্রুয়ারি কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রদের কমনরুমে।
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল এর ইতিহাস
আধুনিক শিক্ষার প্রসারে ব্রিটিশ আমলে জেলা শহরগুলোতে স্কুল প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল সেই প্রক্রিয়ারই অংশ।
চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সরকারি স্কুল এবং শহরের প্রথম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলও ছিল এটি। প্রতিষ্ঠা কালে এই বিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট স্কুল’।
যদিও প্রথম ব্যাচে কত শিক্ষার্থী ছিল সে সম্পর্কে কোনও আনুষ্ঠানিক রেকর্ড নেই, তবে বলা হয়ে থাকে শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলটি যাত্রা শুরু করেছিল।
প্রথম ব্যাচের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ছিলেন জমিদার এবং পর্তুগিজ খ্রিস্টান।
তবে প্রতিষ্ঠার সময় স্কুলটি এখনকার (বর্তমান) জায়গায় ছিল না। এর অবস্থান ছিল চকবাজার প্যারেড ময়দানের দক্ষিণে ও বর্তমান মহসিন কলেজের পূর্ব দিকে।
১৮৬৯ সালে সেখানে সরকারি এফ এ কলেজ বর্তমানে চট্টগ্রাম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে বিদ্যালয়টি মার্কট সাহেবের পাহাড়ের দক্ষিণ প্রান্তে বর্তমান সরকারি মুসলিম হাইস্কুলের দক্ষিণ পাশে একটি পাকা ভবনে স্থানান্তর করা হয়।
পরে ১৮৮৬ সালে বিদ্যালয়টি আইস ফ্যাক্টরি রোডের বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়।
স্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে নাম বদলে গিয়ে হয়েছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল। নাম পরিবর্তনের পরেও, স্কুলটি বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত এন্ট্রান্স স্কুল নামে পরিচিত ছিল।
এ স্কুলের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন মি. কুন্ডু। ১৯৯২ সালে স্কুলটি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ স্কুল হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
প্রসঙ্গত, স্থানান্তরিত হওয়ার পর ১৩৫ বছর ধরে আইস ফ্যাক্টরি রোডের বিদ্যালয়টির চেহারায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কলেজ কিন্তু স্কুলই রয়ে গেল নামকরণে
২০০৭ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল কেবলমাত্র এসএসসি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। নগরীতে কলেজ সংকট কাটাতে সরকার ২০০৮ সালে কলেজিয়েট স্কুলকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করে।
কলেজ উন্নীত হলেও কিন্তু স্কুলই রয়ে গেল হিসেবের খাতায়। গত আটবছর ধরে এ কলেজ থেকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের আওতায় এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে কোন পরিবর্তন আসেনি।
স্কুল সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল’ এ নামটিতে কলেজিয়েট শব্দ লেখা থাকার কারণে এটিকে স্কুল এন্ড কলেজ লেখা যাচ্ছে না।
আবার কলেজিয়েট নাম থাকার কারণে সরাসরি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট কলেজও লেখা যাচ্ছে না। কলেজিয়েট শব্দটি হচ্ছে বিশেষণ। অর্থাৎ কলেজ বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে কলেজিয়েট।
একাডেমিক কার্যক্রম
চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল নিঃসন্দেহে চট্টগ্রাম আধুনিকায়নে বড় ভূমিকা পালন করেছিল। বিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের যে ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল যা তত্কালীন চট্টগ্রামে অকল্পনীয় ছিল না।
১১ একরের বিশাল জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে প্রাতঃ শাখা, দিবা শাখা ও উচ্চ মাধ্যমিক এ তিন শাখায় মাধ্যমে চলছে পাঠ্যক্রম। প্রাতঃ এবং দিবা শাখার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা শিক্ষক/শিক্ষিকা।
প্রাতঃকালীন শাখার কার্যক্রম চলে সকাল ৭ টা ১৫ মিনিট থেকে ১১ টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত। দিবা শাখার কার্যক্রম চলে ১২ টা থেকে ৪ টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত।
স্কুলে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মোট ৩৪ টি শাখা রয়েছে। এদের ১৪ টি প্রাতঃ শাখার এবং ১৪ টি দিবা শাখার।
প্রতি বিভাগে ৫ম শ্রেণীতে ২ টি, ষষ্ঠ শ্রেণীতে ২ টি, ৭ম শ্রেণীতে ৩ টি, ৮ম শ্রেণীতে ৩ টি, ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে ৩ টি করে শাখা রয়েছে।
এছাড়াও ২০০৮ সালে অত্র স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক শাখা খোলা হয়েছে। এতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ৩২০ জন ছাত্র রয়েছে। যার মাঝে বিজ্ঞান শাখায় সিট ৮০ টি এরং ব্যবসায়িক শিক্ষায় ৮০ টি।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে সেরা
এসএসসির ফলাফলে গত ১৯ বছরের মধ্যে ১৭ বছর কলেজিয়েট স্কুল চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে শীর্ষে ছিল। ছয়বার দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় এই প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের সেরাদের একটি।
২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে জিপিএ ৫ পাওয়ার হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল।
এক্ষেত্রে নিজেদের অতীতের সব রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলটি।
২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় এই স্কুল থেকে সর্বোচ্চ ৪৩৮ জন জিপিএ ৫ পেয়েছে। জিপিএ ৫ চালু হওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ জিপিএ ৫ পাওয়ার রেকর্ড এটি।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- হাটহাজারী মাদ্রাসা: উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কওমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
- চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন: এ অঞ্চলের প্রাচীনতম পৌরসভা আজকের সিটি কর্পোরেশন
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
- কর্ণফুলী নদী: হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের অমর সাক্ষী!
এবারে স্কুলটি থেকে ৪৭০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাশ করে ৪৬৯ জন। অর্থাৎ ফেল করেছে একজন শিক্ষার্থী৷
উল্লেখ্য, পাশের হারে সেরাদের তালিকায় না থাকলেও সর্বোচ্চ সংখ্যক পাশ ও জিপিএ ৫ নিয়ে এসএসসি পরীক্ষার সাফল্যে চট্টগ্রামে কলেজিয়েট হাই স্কুল বরাবরের মত শীর্ষে।