চন্দনাইশের পেয়ারা চট্টগ্রাম ছাড়াও বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পেয়ারার হাট বসে চন্দনাইশের রৌশন হাটে।
আঞ্চলিক গানের শিল্পী সঞ্জিত আচার্য ও শেফালী ঘোষের একটি গান ‘গয়াম ভাল পটিয়ার, তরমুজ ভাল পতেঙ্গার’। চট্টগ্রামে আঞ্চলিক ভাষায় পেয়ারাকে বলা হয় ‘গোয়াছি কিংবা গয়াম’।
সারা দেশে বিখ্যাত পটিয়া-চন্দনাইশের পেয়ারা। মিষ্টি বেশি, বিচির সংখ্যা তুলনামূলক কম। পাকলে ভেতরে কোনোটি সাদা, কোনোটি হলুদ, কোনোটি লালচে।
প্রতি মৌসুমেই বারি, বাউ, ইপসা, কাজী ও কাঞ্চনসহ ১৩ জাতের ছোট-বড়, সবুজ, আধা-পাকা পেয়ারার বাম্পার ফলন হয়। বংশ পরম্পরায় পেয়ারা চাষ ও বিক্রিতে নিয়োজিত এ অঞ্চলের অর্ধলক্ষ মানুষ।
পাহাড়ি অঞ্চলে উৎপাদিত এই পেয়ারা বেপারিদের হাত ঘুরে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
এছাড়া, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও জনপ্রিয় ফল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
চন্দনাইশের পেয়ারা চাষে ব্যবহার করতে হয় না কোন ঔষুধ বা রাসায়নিক পদার্থ। শুধুমাত্র বছরে একবার গাছের ডাল পালা ছেঁটে দিয়েই বাগানের দায়িত্ব শেষ করতে হয়।
সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাছে ফুল আসে। জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পর্যন্ত বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করা হয়।
চন্দনাইশের কাঞ্চন পেয়ারা সর্বোচ্চ ওজনে ১ কেজি ও সর্বনিম্ন ২৫ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রাকৃতিকভাবেই এই পেয়ারা স্বাদে সুমিষ্ট, ঘ্রাণে মোহনীয় এবং দেখতে খুব সুন্দর।
একেকটি গাছ থেকে ৫০০ থেকে ৭০০ পেয়ারা পাওয়া যায়।
প্রতি মৌসুমে দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার বাগানে উৎপাদিত হয় ২০-৩০ কোটি টাকার পেয়ারা।
ভোরেই বাগানগুলো হয়ে ওঠে সরব। পেয়ারা সংগ্রহে নেমে পড়েন শ্রমিকরা।
ভোরের আলো না ফুটতেই পাহাড় থেকে দল বেঁধে পেয়ারা নিয়ে বাজারে ফিরছেন চাষিরা। লাল কাপড়ে মোড়ানো পুঁটলি বেঁধে আনা হচ্ছে তিন থেকে চার মাইল পায়ে হেঁটে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার ১৬টি হাট ও খোলা জায়গায় বিক্রি হয় চন্দনাইশের পেয়ারা। তবে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা বেচাকেনা হয় চন্দনাইশ উপজেলার রওশন হাটে।
চন্দনাইশের পেয়ারা এর ইতিকথা
জনশ্রুতি আছে, ১৮৫০ সালের দিকে পটিয়ার কচুয়াই চা–বাগানের মালিক হেগিন্স লন্ডন থেকে প্রথমে আনারস, পরে পেয়ারা ও লিচু বীজ এনে তাঁর বাংলোর আশপাশে রোপণ করেন। পরে ওই বীজ থেকে চারদিকে বাগান ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয়ভাবে পেয়ারাকে কেউ ‘গয়াম’, কেউ ‘গোয়াছি’ বলে।
কাঞ্চননগর এলাকার প্রবীণ বাগান মালিক আইয়ুব আলী খানের দাবী, ১৯৬০ সালের দিকে দক্ষিণ শ্রীমাই এলাকায় মাত্র ১০ একর জায়গায় পেয়ারাবাগান শুরু করেন তাঁর বাবা মরহুম খলিলুর রহমান।
১৯৮০ সাল থেকে তিনিসহ তাঁর ভাইয়েরা মিলে বাগান বাড়াতে থাকেন। বর্তমানে পাঁচ ভাইয়ের ৪০ একর পেয়ারা বাগান রয়েছে।
বর্তমানে, পটিয়ার পাহাড়ি এলাকার হাইদগাঁও, কচুয়াই, খরনা এবং চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর থেকে দোহাজারী এলাকার কাঞ্চননগর, হাসিমপুর ও জামিজুরী ইউনিয়নের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষের পেয়ারাবাগান রয়েছে।পেয়ারাই তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
- ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিল: চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার
- সাঙ্গু নদী: অদ্ভুত সুন্দর এক পাহাড়ী নদী
- কালুরঘাট সেতু: ঐতিহ্যের স্মারক হালুরঘাডর পোল!
কৃষি অফিসের তথ্য মতে, দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার একর জমিতে পেয়ারা চাষ হচ্ছে।
ছোট-বড় পেয়ারার বাগান আছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার।
এর মধ্যে চন্দনাইশের হাশিমপুর ও কাঞ্চন নগর গ্রামে আছে প্রায় ২ হাজার বাগান। বেশিরভাগ বাগান গড়ে উঠেছে পাহাড়ে।
বাকিগুলো শঙ্খ নদী ও শ্রীমতী খালের পার্শ্ববর্তী এলাকায়।
তবে এসব বাগানের মধ্যে কাঞ্চন নগরের পেয়ারা (চন্দনাইশের পেয়ারা, চন্দনাইশের পেয়ারা) খুবই বিখ্যাত। এসব পেয়ারা অত্যন্ত সুস্বাদু। বাজারে কাঞ্চন নগরের পেয়ারার চাহিদাও বেশি।
পেয়ারার হাট
লাল কাপড়ের পুটলি বোঝায় সুস্বাদু পেয়ারা। এসব পেয়ারা নিয়ে হাটে কৃষক সারি সারি ভাবে দাঁড়ানো। ক্রেতা এলেই চলে হাঁকডাক। জমে উঠে বিকিকিনি।
চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশের বিভিন্ন এলাকার হাটগুলোতে এমন দৃশ্য এখন নিত্যদিনের।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের রৌশন হাট, বাগিচা হাট, ছৈয়দাবাদ স্টেশন, কাঞ্চননগর, বাদাম তলা, খানহাট, কলেজ গেইট, চা-বাগান রাস্তার মাথা, খানহাট রেলওয়ে স্টেশন, খরনা রাস্তার মাথা, কমল মুন্সির হাটসহ আট-দশ কিলোমিটার এলাকার রাস্তার দুই পাশে অন্তত ১৬ জায়গায় ভোর থেকে বসে পেয়ারার হাট।
পেয়ারার পুষ্টিগুণ:
- এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়, যা কমলালেবুর চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।
- পেয়ারায় আছে ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স
- এতে আছে যথেষ্ট পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ফলিক অ্যাসিড ও নিকোট্রিন অ্যাসিড৷
- উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেয়ারা বেশ কাজ দেয়।
- এটি রক্তসঞ্চালন ঠিক রাখে এবং কোলেস্টরেল নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে হৃদ্রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা পেয়ারা খেতে পারেন৷
- অ্যাজমা, স্কার্ভি, স্থূলতা, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ইত্যাদি অসুখের ক্ষেত্রেও পেয়ারা বেশ উপকারী৷
- জটিল শর্করা ও তন্তুসমৃদ্ধ পেয়ারা রক্তের চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।
- শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট-সমৃদ্ধ পেয়ারা পাতার জুস গ্যাস্ট্রাইটিসের সমস্যায় উপকারী।
- পেয়ারা ওজন কমাতে সাহায্য করে এবং এই ফলের রস সর্দি-কাশি, কোষ্ঠকাঠিন্য ও আমাশয়সহ পেটের অসুখ সারাতে পারে
- বয়সের সঙ্গে জড়িত নানা রোগ যেমন: স্মৃতিভ্রংশ (আলঝেইমার), চোখে ছানি, আর্থরাইটিস বা হাঁটুব্যথা প্রতিরোধে সহায়তা করে।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় পেয়ারার হাট বসে চন্দনাইশের রৌশন হাটে।
অতি সম্প্রতি এই হাটে গেলে চোখে পড়ে, মহাসড়কের দুপাশজুড়ে লাল কাপড় বাঁধা পেয়ারার সারি সারি ভার নিয়ে বসে আছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে হাজারো মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে থাকে পেয়ারার বাজারগুলো।
তবে বিক্রির জন্য নির্দিষ্ট স্থান না থাকায় রাস্তার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে পেয়ারা বিক্রি করতে হয় তাদের।
সুনাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে
পটিয়া ও চন্দনাইশে উৎপাদিত পেয়ারা পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, স্বাদেও অনন্য। এসব পেয়ারা স্বাস্থ্যসম্মত আর সুস্বাদু হওয়ায় সুনাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
এখানকার পেয়ারা বিষমুক্ত আর সুস্বাদু বলে চাহিদা আছে সারাদেশে। তবে সংকট সংরক্ষণ সুবিধার।
সম্ভাবনাময় সুমিষ্ট পাহাড়ি পেয়ারা একদিকে মানুষের রসনা তৃপ্ত করছে, অন্যদিকে হাজারও কৃষকের ভাগ্য বদলে দিয়েছে।
এ ফল চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারও মানুষের।
শঙ্কার কথা, এখানকার অনুন্নত রাস্তাঘাট আর সম্প্রতি গড়ে উঠা বেশ কিছু ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় কমে গেছে ফলন, এতে ক্ষতিগ্রস্থ বাগান মালিকরা।
চন্দনাইশের পেয়ারা যাচ্ছে বিদেশে
পেয়ারা চাষে ইতোমধ্যে অনেক পরিবার শূন্য থেকে পরিণত হয়েছে লাখপতিতে। চন্দনাইশ উপজেলার শত শত পাহাড়ে বিপুল পরিমাণে উৎপাদিত হয় পেয়ারা।
খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এখানকার পেয়ারার চাহিদা রয়েছে দেশব্যাপী। এমনকি বিদেশেও রয়েছে এসব পেয়ারার চাহিদা।
এখানে উৎপাদিত পেয়ারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে রপ্তানি করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে।
সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা পাইকারীহারে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব বলেও মনে করেন পেয়ারা চাষের সাথে সংশ্লিষ্টরা।
কাজি পেয়ারা বনাম কাঞ্চননগরী পেয়ারা
বাংলাদেশের আপেল হিসেবে খ্যাত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ সুস্বাদু পেয়ারার একটি উন্নত জাত কাঞ্চননগরী পেয়ারা। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, খেতে সুস্বাদু ও দেখতে সুন্দর বলে এ পেয়ারার কদরও বেশি।
পেয়ারা চাষীরা জানান, দেশে দুই জাতের পেয়ারা রয়েছে। একটি কাজী পেয়ারা আর অন্যটি কাঞ্চননগরী পেয়ারা।
কাজী পেয়ারা আকারে বড় হলেও স্বাদ একটু কম।
অন্যদিকে কাঞ্চননগরী পেয়ারার আকার ছোট হলেও স্বাদ ও পুষ্টিতে ভরপুর। চট্টগ্রামের পটিয়া ও চন্দনাইশের কাঞ্চননগর এলাকা এই পেয়ারার মূল উৎপাদনস্থল।
সমস্যার সমাধান প্রয়োজন
পেয়ারা চাষীদের রয়েছে বেশ কিছু সমস্যাও। পেয়ারা বিক্রির জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থান নেই। নেই চন্দনাইশের পেয়ারা খ্যাত এই অঞ্চলের পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য সুব্যবস্থাও।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- কালুরঘাট সেতু: ঐতিহ্যের স্মারক হালুরঘাডর পোল!
- কর্ণফুলী নদী: হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের অমর সাক্ষী!
- ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিল: চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার
পেয়ারা চাষীরা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নামমাত্র মূল্যে আগাম সুবিধাভোগীদের কাছে পেয়ারা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এতে অনেক চাষীই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন।
এছাড়াও, পেয়ারা চাষের সঙ্গে জড়িতদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সুদমুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হলে পেয়ারা চাষে আরো অনেকেই ঝুঁকে পড়বে। এতে বেকারত্ব দূর হবে অনেকের।