চুনতি অভয়ারণ্য, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে এশিয়ান বন্য হাতি যাতায়াতের অন্যতম করিডর। ২০১২ সালে এ অভয়ারণ্য জাতিসংঘের ইকুয়েটর পুরস্কার লাভ করে।
প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় অবস্থিত চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশেই এ বনাঞ্চলের অবস্থান।
স্থানীয়দের কাছে এটি চুনতির বন নামে বেশ পরিচিত।
এই বন বা অভয়ারণ্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বন্য এশিয়ান হাতি যাতায়াতের অন্যতম করিডর এবং প্রজননক্ষেত্র।
নরম মাটি, ঝরনা আর ভূগর্ভস্থ পানিপ্রবাহের কারণে বনটি এশিয়ান হাতির প্রজননক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহূত হয়।
বাংলাদেশ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪-এর আলোকে ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চকরিয়া ও বাঁশখালী এলাকায় ১৯ হাজার ১৭৭ একর (৭ হাজার ৭৬৪ হেক্টর) জমি নিয়ে চুনতি অভয়ারণ্য এলাকা গড়ে উঠে।
১৯৯২ সালে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের অধীনে অভয়ারণ্য প্রকল্পের কাজ শুরু হয়।
বনাঞ্চল সুরক্ষা, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২০০৩ সালে এলাকায় চুনতি ও জলদী রেঞ্জের অধীনে ৭টি বিট অফিস স্থাপন করা হয়।
পরবর্তীতে পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করার জন্য অভয়ারণ্য এলাকায় বনপুকুর, প্রাকৃতিক গর্জন বনাঞ্চল, এশিয় বন্যহাতির বিচরণ ক্ষেত্র, গয়ালমারা প্রাকৃতিক হ্রদ, বনপুকুর ফুটট্রেইল, জাঙ্গালীয়া ফুটট্রেইল, পর্যটন টাওয়ার, গোলঘর, স্টুডেন্ট ডরমিটরি, নেচার কনজারভেশন সেন্টার, গবেষণা কেন্দ্র, ইকোকর্টেজসহ বিভিন্ন প্রতিবেশ পর্যটন বা ইকোট্যুরিজম স্থাপন করা হয়।
পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে সহজে অভয়ারণ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসহ এশিয়ান হাতি ও অন্য বন্যপ্রাণীর এবং পাখির অবাধ বিচরণ উপভোগ করা যায়।
চুনতি অভয়ারণ্য প্রধানত ক্রান্তীয় মিশ্র-চিরহরিৎ বনভূমি, যা হালকা থেকে খাড়া ঢালবিশিষ্ট পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত গর্জন বেল্টের অন্তর্গত।
বৃক্ষের সৌন্দর্য্যের সমন্বয়, উঁচু-নিচু পাহাড়ে সৃজিত বাগান আর বাগানে পাখিদের মিষ্টি সুরে মুখরিত অভয়ারণ্যটি।
জীববৈচিত্র্যপূর্ণ চুনতি অভয়ারণ্য
জীববৈচিত্র্য ও বন্য প্রাণীর আধার চুনতি অভয়ারণ্য এ গর্জন, চাপালিশ, বাঁশ, বেত, গুল্ম, ঘাসসহ প্রায় ১০৭ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে।
এ বনে রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৩ প্রজাতির পাখি, চার প্রজাতির উভচর ও সাত প্রজাতির সরীসৃপ।
৭ হাজার ৭৬৪ হেক্টরের অভয়ারণ্যে প্রায় ১০৭ প্রজাতির ১২ লাখেরও বেশি গাছ মধ্যে ১৫ প্রজাতির গাছ এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে।
চুনতি অভয়ারণ্য এ বেশকিছু শতবর্ষী গর্জন গাছ ছাড়াও শাল, সেগুন, আকাশমণি, গর্জন, বট, হারগোজা, চাপালিশ, হরীতকী, বহেরা, বাঁশ, আসাম লতা, ছন প্রভৃতি উদ্ভিদ বেশি দেখা যায়।
এ অভয়ারণ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাণী এশীয় হাতি। বন্যহাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল চুনতি অভয়ারণ্য।
এক পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২৬৪টি বন্য হাতির উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক বাস করছে এ অভয়ারণ্যে।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার: ‘বোস্তামীর কচ্ছপ’ পৃথিবীতে বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রাণী
- মগের মুল্লুক: মগদের আদি নিবাস ‘ইংরা হংপ্রা’ সাতকানিয়ায়
- ভাসানচর: আমূল বদলে যাওয়া এক দ্বীপের গল্প!
এশিয়ান হাতি ছাড়াও চুনতি অভয়ারণ্য এ সাধারণত দেখা মেলে লালমুখো বানর, মুখপোড়া হনুমান, খেঁকশিয়াল, সজারু, মায়া হরিণ, বন্যশূকর, শিয়াল, নানারকম গিরগিটি, সাম্বারসহ অন্যান্য প্রাণীর।
এ ছাড়া এ বনে সাপের মধ্যে কালান্তর, দাঁড়াশ, গোখরা, অজগর, লাউডগা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন জাতের পাখিরও অভয়াশ্রম এ বনাঞ্চল। উল্লেখযোগ্য পাখপাখালি হলো বনমোরগ, লাল মৌটুসি, নীলকণ্ঠী, পাহাড়ি ময়না, মথুরা, ঘুঘু, ফিঙে, কাঠঠোকরা, ধনেশ, টিয়া, বুলবুলি ইত্যাদি।
তবে অভয়ারণ্যের একটি প্রবেশ পথের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ৪৬৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ৬৯১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে।
সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের জন্য চুনতি অভয়ারণ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে।
এশিয়ান হাতির অন্যতম আবাসস্থল এবং হাতির প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র চুনতি অভয়ারণ্য ২০১২ সালে বন ও পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় জাতিসংঘের ‘ইকুয়েটর পুরস্কার’ লাভ করে।
অভয়ারণ্যে মানুষের বসতি
মানুষের দখলের কবলে পড়েছে এশিয়ায় বন্য হাতি বিচরণের নিবিড় স্থান ও প্রজননক্ষেত্র চুনতি অভয়ারণ্য।
ফলে এই বন থেকে বন্য প্রাণীরা সরে যাচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
বন সংরক্ষণের জন্য জাতিসংঘের ইকুয়েটর পুরস্কারজয়ী এই বনের ১৯ হাজার ১৭৭ একরের মধ্যে প্রায় চার হাজার একর জমি দখল করে ৫০ হাজারের অধিক মানুষ বসতি গড়ে তুলেছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে গড়ে ওঠা মানববসতি এভাবে বাড়তে থাকলে এই বন থেকে বন্য প্রাণীরা চিরতরে হারিয়ে যাবে।
চার হাজার একর জমিতে এখন মানববসতি গড়ে উঠায় এই বনের বাসিন্দা বন্য প্রাণীরাও বিপদে পড়েছে।
তারা এখন বনছাড়া হতে চলেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ, ১৯৯০ সাল থেকে চুনতি অভয়ারণ্যের বন ও পরিবেশের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।
তার মতে, যে হারে অভয়ারণ্যে অবৈধ বসতি ও জবরদখল বেড়েছে, তাতে চুনতি অভয়ারণ্যে কয়েক হাজার একর বনভূমি ইতিমধ্যে বেদখল হয়েছে।
এতে অভয়ারণ্যের ভেতর থাকা বন ও বন্য প্রাণী মারাত্মক হুমকির মুখে।
বনের ভেতরে হবে রেলপথ
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেললাইনের একটি অংশের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে বন বিভাগ।
তারা বলেছে, চুনতি অভয়ারণ্য এর বুকচিরে (কোর জোন) যাচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ।
এতে অভয়ারণ্যের সুদূরপ্রসারী ক্ষতির পাশ-পাশি; হুমকিতে পড়বে বিশাল জীববৈচিত্র্য।
বৃক্ষনিধন, শব্দদূষণ ও ভীতির কারণে হারিয়ে যেতে পারে শতবর্ষী গাছে বাস করা বিলুপ্ত প্রায় বহু পাখিসহ নানা বন্যপ্রাণী।
বন বিভাগের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ চুনতি অভয়ারণ্যের ভেতর প্রায় ১০ কিলোমিটার যাবে।
এতে, বুনো হাতির চলাচলে বাধা তৈরি হবে। ওই রেললাইনের ২১টি স্থানে রয়েছে হাতির বসতি ও চলাচলের পথ।
এছাড়া, রেলপথ যাওয়ার কারণে কাটা পড়বে শতবর্ষী অন্তত পঞ্চাশটি মা গর্জন গাছসহ অর্ধলক্ষাধিক গাছ। নষ্ট হবে জলাধারসহ বিভিন্ন ছড়া।
সংস্থাটি বলেছে, রেললাইন নির্মিত হলে এ বনের অনেক স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে।
বন্য প্রাণীর আবাসস্থল খণ্ডিত হয়ে পড়বে। ফলে বন্য প্রাণীর বিচরণ সীমিত হয়ে পড়বে।
ট্রেনের ধাক্কায় বন্য প্রাণীর মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। এশীয় প্রজাতির হাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে।
বনজসম্পদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলছে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর। হাতির চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসবের জন্য ১৭৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুনধুম পর্যন্ত ১২৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ কাজ চলছে।
বিপন্ন প্রাণীর লাল তালিকায় আছে এশিয়ান এলিফ্যান্ট
চলাচলের করিডোর বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং খাবার সংকটের কারণে নিয়মিতভাবে লোকালয়ে হানা দিচ্ছে বিপন্ন এশিয়ান হাতি। ফলে বাড়ছে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্বও।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ফরেস্ট (আইইউসিএন) প্রকাশিত বিপন্ন প্রাণীর লাল তালিকায় আছে এশিয়ান এলিফ্যান্ট।
সংস্থাটির তথ্যমতে, এশিয়ান হাতিগুলো মিয়ানমার এবং ভারতে আসা যাওয়া করে।
মিয়নমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে বনভূমি উজাড় হওয়া, সীমান্তে মাইন পোঁতা, এবং বনের জায়গায় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হাতি চলাচলের করিডোর।
তাছাড়া চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণের ফলে সংরক্ষিত বন যেমন ভাগ হবে, তেমনি হাতিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীও হুমকিতে পড়বে। ওই রেললাইনের অন্তত ২১টি স্থানে পড়বে হাতির বসতি এবং চলাচলের পথ।
বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২০০৩ সালে থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত হাতির আক্রমণে ২৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আবার একই সময়ে হাতি মারা গেছে ৬২টি।
সর্বশেষ গত এক বছরের হাতি মারা গেছে তিনটি। আইইউসিএনের ২০১৬ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেশের মোট হাতির সংখ্যা ২১০-৩৩০টি। চট্টগ্রাম অঞ্চলে হাতি রয়েছে ২৬৮টি।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চন্দনাইশের পেয়ারা: পথ দেখাচ্ছে স্বাদের ‘কাঞ্চন নগরের গয়াম’
- ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিল: চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার
- সাঙ্গু নদী: অদ্ভুত সুন্দর এক পাহাড়ী নদী
সবচেয়ে বেশি হাতি দেখা যায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে। এখানে হাতি রয়েছে ৬৫টি।
কক্সবাজার দক্ষিণে ৫৪টি, উত্তরে ৬৩টি, লামায় ৩০টি, বান্দরবানে ১১টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরে ২৮টি এবং দক্ষিণে ১৭ হাতি রয়েছে।
বনে যেতে টিকেট লাগে
চুনতি অভয়ারণ্য-এ প্রবেশে বাংলাদেশিদের জন্য দশ টাকা আর বিদেশি নাগরিকদের জন্য তিন আমেরিকান ডলার বা সমপরিমাণের বাংলাদেশি টাকা পরিশোধ করতে হয়।
জায়গাটিতে ভ্রমণ করতে কোনো ইকো গাইডের সহায়তা নিতে পারেন।
তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।