দিয়াং বা দেয়াঙ পাহাড় চট্টগ্রামের প্রাচীন জনপদ। দিয়াংয়ের গৌরবগাথা এখনো লোকমুখে ফেরে। ১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকরা চট্টগ্রামে আসেন। দিয়াংয়ে বসতি গড়েন ১৫৩৭ সালে।
ঐতিহাসিক দেয়াঙ পাহাড় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী বর্তমান আনোয়ারা-কর্ণফুলী বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত।
ধারণা করা হয় দেয়াঙ পাহাড়েই ছিল চট্টগ্রামের প্রাচীন পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়।
কবি আলাওল সতীময়না কাব্যে দেয়াঙয়ের কথা বলেছেন এভাবে—
কর্ণফুলী নদী পূর্বে আছে এক পুরী।
রোসাঙ্গ নগর নাম স্বর্গাবতারি।
আরাকান রাজাদের রাজধানী ছিল দেয়াঙ। আরাকানিদের চাটিগাঁ দুর্গ আর দেয়াঙ কারাগার ছিল এখানে। কবি আলাওল এই কারাগারে বন্দিও ছিলেন।
অনেক গবেষকের মতে, চট্টগ্রামের প্রাচীন পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় এই দেয়াঙ পাহাড়েই ছিল। দেয়াঙ একসময় ত্রিপুরা রাজাদের অধীনেও ছিল।
ইতিহাস বলে, সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজ বণিকদের দেয়াঙ পাহাড়ে কুঠি ও গির্জা নির্মাণের অনুমতি দেন।
মোগল আমলে আরাকানি সৈন্যরা ফিরিঙ্গি বন্দর ও ফিরিঙ্গি পল্লীর কাছে তিনটি ঘর তৈরি করে। মোগল সেনারা আরাকানিদের পরাজিত করে দিয়াংয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বলা হয়, পণ্ডিত বিহারটিও তখনই ধ্বংস হয়।
মোগলদের ইতিহাসবিদ শিহাব উদ্দিন তালিশ তাঁর ফাতিয়া-ই-ইব্রিয়ায় আরাকানিদের চাটিগাঁ দুর্গ, মগঘাট, মগবাজার ও সেনাছাউনির বিশদ বিবরণ লিখে গেছেন।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- বাংলাদেশের প্রাচীন গির্জা: চট্টগ্রামের ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’
- মগের মুল্লুক: মগদের আদি নিবাস ‘ইংরা হংপ্রা’ সাতকানিয়ায়
- ইতিহাসের সাক্ষী চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি: নির্মল ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে ৭৩১ যোদ্ধা
সম্রাট আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল আইন-ই-আকবরীতে লিখেছেন, চট্টগ্রাম সমুদ্র তীরবর্তী এবং পর্বত মধ্যস্থিত একটি বৃহৎ বন্দর। এটা খ্রিস্টান ও অন্য বৈদেশিক বণিকদের একটি প্রধান বাণিজ্য স্থান। এই বন্দর মগরাজাদের অধিকারভুক্ত।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের পর্তুগিজ লেখকদের লেখায় বারবার এসেছে ‘সিটি অব বাংলা’র নাম। এই ‘সিটি অব বাংলা’ হচ্ছে চট্টগ্রাম।
ফাদার হস্টেনের মতে, ‘সিটি অব বাংলা’ হচ্ছে দেয়াঙ। তার মতে, বাংলার উপকূলে এই দেয়াঙেই প্রথম পর্তুগিজ বসতি স্থাপিত হয়েছিল।
দেয়াঙ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ছিল।
অনেকে চট্টগ্রাম বন্দরকে দেয়াঙের সঙ্গে মিলিয়ে ফেললেও এটা প্রমাণিত যে, পর্তুগিজরা মূলত চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করেই এ অঞ্চলে সমবেত হয়েছিল। গত শতকের শুরুর দিকে দেয়াঙ পরিচিত হয় ‘ফিরিঙ্গি বন্দর’ নামে।
দেয়াঙ পাহাড় এ জমিদারবাড়ি
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেহাল দশা হয়ে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটি। বড়উঠান গ্রামে এক সময় বসবাস ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় জমিদারের।
‘বড় উঠান মিয়া বাড়ি’ নামে পরিচিত এ বাড়ি বা পরিবারটির প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান মনোহর আলী খান (রাজা শ্যামরায়)।
ইট-সুরকির গাঁথুনিতে পুরু দেয়ালের দ্বিতল এই বাড়িটিতে একসময় আনন্দের হিল্লোল উঠত। জমিদার, তাঁর পুত্র-কন্যা, পাইক-পেয়াদা মুখর করে রাখতেন বাড়িটি। ৭০ থেকে ৭৫ বছর বাড়িটি পরিত্যক্ত পড়ে আছে।
পরিবারটির বয়স ৩৬০ বছরের ওপরে। পরিবারটিকে বলা হয় চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদার পরিবার। একসময় তাঁদের জমিদারি হাতিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল।
বাংলার নবাব শায়েস্তা খাঁ যখন চট্টগ্রাম বিজয় করেন, তখন তাঁর প্রধান সেনাপতি ছিলেন বড় ছেলে বুজুর্গ উমেদ খান। উমেদ খানের সহযোগী সেনাধ্যক্ষ ছিলেন রাজা শ্যামরায়। পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেওয়ান মনোহর আলী খান নাম নেন।
রাজা শ্যামরায়ের পরগনার নাম ছিল দেয়াঙ পরগনা। দেয়াঙ পাহাড়ের পাদদেশে এর অবস্থান। এখন জায়গাটি পড়েছে নবগঠিত কর্ণফুলী উপজেলার ২ নম্বর বড় উঠান ইউনিয়নে।
রাজা শ্যামরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাঁর পরিবারের আর কোনো সদস্য সধর্ম ত্যাগ করেননি।
সাংবাদিক জামালউদ্দিনের লেখা দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস বই থেকে জানা যাচ্ছে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর মুসলিম নারীকে বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন শ্যামরায়। খবর পৌঁছে যায় শায়েস্তা খাঁর কাছে।
অবশেষে শায়েস্তা খাঁ নিজ কন্যার সঙ্গে মনোহর আলী খানের বিয়ে দিতে সম্মত হন। এই বিয়ের মধ্য দিয়ে নবাব পরিবারভুক্ত চট্টগ্রামের জমিদারির এক-চতুর্থাংশ লাভ করেন মনোহর আলী খান ও তাঁর স্ত্রী। সেটা ১৬৬৬ সালের কথা।
জানা যায়, ১৬৬৫ সাল থেকে এ পরিবারের জমিদারি শুরু হয়। দীর্ঘ কয়েকশ বছর জমিদারি চলার পর ১৯৩০ সালে প্রজাতন্ত্র আইনের ভিত্তিতে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে কমতে থাকে জমিদার বংশীয়দের শৌর্যবীর্য।
পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে পুরনো পটিয়ার বড়উঠানের সবচেয়ে বড় জমিদার বাড়িটি। এক সময় বাড়ির পেছনে আরেকটি একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়।
জমিদারের বংশধররা গ্রামের বাড়িতে গেলে সেখানে বসবাস করতেন। সেটিও এখন বসবাসের অনুপযোগী। পুরাতন ভবনটির কোনো সংস্কার না হওয়ায় তা পুরোপুরি বিলুপ্তির পথে।
দেয়াঙয়ের রানি মা মারিয়া
দেয়াঙ গ্রামের রাস্তার দক্ষিণ ধারে মরিয়ম আশ্রম আর মা মারিয়ার গ্রোটো (কৃত্রিমভাবে নির্মিত গুহা)। আশ্রমটি তৈরি হয় ১৬০০ সালে।
মা মারিয়ার গ্রোটোটি পাহাড়ের ওপর। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।
কংক্রিট ঢালাই দিয়ে তৈরি গ্রোটোর ভেতরে প্রার্থনারত মা মারিয়ার মূর্তি। তাঁর গলায় জপমালা। দুই পাশে দানবাক্সও আছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতি ও শুক্রবার এখানে তীর্থ দর্শনে আসে সারা দেশের মানুষ। আশ্রম প্রাঙ্গণ তখন লোকারণ্য থাকে।
‘মা মারিয়া তীর্থ উৎসবে’ খ্রিস্টানদের মিলনমেলা
চট্টগ্রামে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘মা মারিয়া তীর্থ উৎসব’। প্রতিবছর বর্ণাঢ্য আয়োজনে এ উৎসব উদযাপন হয়।
উৎসবকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার দৌলতপুরে দেয়াঙ পাহাড়ে মা মরিয়ম আশ্রমে খ্রিস্ট সম্প্রদায়ের মানুষের মিলনমেলা বসে।
সম্মিলিত খ্রিস্টযজ্ঞে অংশ নেন কয়েক হাজার বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ ও শিশু।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আর্চডায়োসিসের পালকীয় সমন্বয়কারী মানিক উইলভার ডি কস্তা বলেন, ‘প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার মানুষের সম্মিলনে দুই দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করা হয়।
১৯৭৬ সাল থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কোল ঘেঁষা দেয়াঙ পাহাড়ে এই উৎসবের আয়োজন করে আসছেন বাংলাদেশের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা।
বাংলাদেশে প্রথম খ্রিস্টান পরিবার
দেয়াঙ পাহাড়ে প্রথম বসতি স্থাপন করে ছিলো বাংলাদেশে আগত প্রথম খ্রিস্টান পরিবার ।
আর সেখান থেকেই সময়ের সাথে সাথে ছড়িয়ে পরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এই খ্রিস্টবিশ্বাসীগন।
সেখানে এখনো দুইটি পরিবার ডি’রোজা ও মরেজ পরিবারের বংশধরেরা বাস করছেন।
ধারণা করা হয় ১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকরা চট্টগ্রামে আসেন। দেয়াঙ পাহাড় এ বসতি গড়েন ১৫৩৭ সালে।
পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমানে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত ‘পণ্ডিতবিহার বিশ্ববিদ্যালয়’ উপমহাদেশের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বে এবং পরবর্তীকালে আনুমানিক আঠারো শতকের মধ্যকাল পর্যন্ত অন্য কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
খ্রিস্টীয় আনুমানিক অষ্টম শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান) চট্টগ্রামের দেয়াঙ পাহাড় এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিলো ধারণা করা হয়।
মূলত এটি ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যা পূর্ববঙ্গে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হতো।
পাল সাম্রজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং বৌদ্ধধর্মপ্রচারক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পণ্ডিতবিহারে কিছুকাল অবস্থান ও অধ্যয়ন করেছিলেন।
পণ্ডিতবিহারে অধ্যাপকগণ তাদের অধ্যাপনা, অধ্যয়ন ও যোগ সাধনার পাশাপাশি অবসর-অবকাশে যে সকল গান-দোঁহা রচনা করেছিলেন তাই পরবর্তীকালে চর্যাপদ নামে বাংলা ভাষা ও কাব্যের আদি নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত লাভ করে।
দেয়াঙ পাহাড়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়
ইসলামাবাদীর স্বপ্ন ছিল সুন্দর-শিক্ষিত, উজ্জীবিত, কুসংস্কারবিহীন এক স্বাধীন সত্য মানুষ। সেই অনাগত মানুষের স্বপ্নে তিনি বিভোর থাকতেন।
তার জন্য কেবলমাত্র বিতর্ক, বক্তৃতা ও প্রচার মিশনের কাজ করেই তিন ক্ষান্ত হতেন না, আদর্শ প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে সুষ্ঠু পরিবেশ যাতে গড়ে ওঠে সে জন্যেও তিনি চেষ্টিত থাকতেন।
চট্টগ্রামের দক্ষিণ মহকুমার কর্ণফুলীর তীরবর্তী দেয়াঙ পাহাড়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তার আজীবন।
এ লক্ষ্যে ১৯১৮ সালের ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে তৃতীয় আঞ্জুমানে ওলামার সম্মেলনে মাওলানা ইসলামাবাদী দেয়াঙ পাহাড়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাবনা পেশ করেন।
সর্ব ভারতের ওলামা মাশায়েখ, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ দেয়াঙে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানান।
এর আগে ১৯১৫ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার থেকে ৬০০ বিঘা জমি ও ওই এলাকার জমিদার আলী খান থেকে ৫০০ কানি ভূমি রেজিস্ট্রিমূলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গ্রহণ করেছিলেন।
বিখ্যাত নেতা ও শিক্ষাবিদ শেরেহিন্দ মাওলানা শওকত আলী এ আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করেন।
জঙ্গে জিহাদ, শাহ বদিউল আলম, শাহ জুলফিকার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবল সমর্থক হন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার লক্ষ্যে ঐ সময় চট্টগ্রামে থাকতে রাজি হন।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- বদর শাহ মাজার: চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন ইমারত হিসেবে স্বীকৃত
- চট্টগ্রাম আদালত ভবন: পরীর পাহাড়ে অনন্য স্থাপত্যকীর্তি!
- কিংবদন্তির ‘চেরাগী পাহাড়’ আছে কেবল নামেই
দেয়াঙে পাহাড়ে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হন ভারতীয় সেরা রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা আকরম খাঁ, মুন্সী রিয়াজ উদ্দিন আহমদ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।
এই অজানা ইতিহাস তুলে ধরা রজন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ,,,
ধন্যবাদ
আমার নিজ এলাকা, ধন্যবাদ অনেক অজানা ইতিহাস তুলে ধরার জন্য।