তথ্য প্রযুক্তির বিকাশে অনলাইন সাংবাদিকতার সামনে হুমকির মুখে প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। একেক দেশে একেক নামে পরিচিত অনলাইন মিডিয়া।
যুগে যুগে নতুনের কাছে হার মানতে হয়েছে পুরাতনকে। নতুনের উত্থানে পুরানের প্রস্থান এটাই স্বাভাবিক। মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই বাস্তবতা।
তথ্য প্রযুক্তির বিকাশে অনলাইন সাংবাদিকতার সামনে হুমকির মুখে প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া।
উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে অনুমান করা যায়, বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতার ভবিষৎ হবে অনলাইনে, সেই সময় বেশি দূরে নয়।
একেক দেশে একেক নামে পরিচিত অনলাইন মিডিয়া। আমেরিকাতে ডাকা হয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল হিসেবে।
ইংল্যান্ডে এর নাম অনলাইন নিউজ পেপার। বাংলাদেশে দুইটাই। তবে সবচাইতে ভালো হয় ওয়েব পোর্টাল হিসেবেই অনলাইন সংবাদের নামকরণ হলে।
পশ্চিমা বিশ্ব বা আমরা যাকে আদর করে বলি ‘ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড’। আর সব কিছুর মতই তারা বিপ্লব ঘটিয়েছে তথ্য প্রযুক্তিতেও।
সে বিপ্লবের ছায়া পড়েছে গণমাধ্যমে। আমেরিকার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ এখন অনলাইন সংবাদে নির্ভরশীল।
অনলাইন মিডিয়ার দাপটে হারিয়ে গেছে বহু বিখ্যাত আর ঐতিহ্যবাহী প্রিন্ট মিডিয়া। এমনকি সংবাদ প্রচারে টিভি-রেডিওগুলোও নিজেদের টিকিয়ে রাখতে নতুন ভাবনায় যেতে বাধ্য হয়েছে।
আমেরিকার মতই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, কানাডা, জার্মান, ইতালিসহ ইউরোপ-আমেরিকা অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশের চিত্রই এমন।
আমরা যদি এশিয়ার কথা বলি তবে জাপান, চীন, কোরিয়াতেও এখন অনলাইন গণমাধ্যমের জয় জয়কার।
পাশাপাশি মিশর, কাতার, সৌদি, ইরান, ইরাকের মত অতি রক্ষনশীল দেশগুলোতেও অনলাইন সংবাদের তুমুল জনপ্রিয়তা।
দাবি করা যায়, এই রাষ্ট্রগুলোতে অনলাইনের জনপ্রিয়তা তুলনামূলক একটু বেশি।
রাষ্ট্রগুলোর সংবাদে স্বাধীনতার অভাব এর মূল কারণ। এইসব দেশে সাংবাদিকেরা স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পারেন না।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- সাংবাদিকতা নয়, পাবলিক রিলেশনস
- ভাল রেডিও উপস্থাপনার চাবিকাঠি
- ‘ইয়োলো জার্নালিজম’ বাংলায় হলুদ সাংবাদিকতা নামে পরিচিত
তাই পাঠকরাও তাদের সংবাদপত্রগুলোকে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ, নির্ভুল মনে করেন না। বাধ্য হয়ে তারা ক্লিক করছেন নানা ওয়েব সাইট, পোর্টালে।
মজার ব্যাপার হল এই দেশগুলোতে ফেসবুক সংবাদপত্র বা সংবাদের জনপ্রিয় সোর্স হিসেবে সমাদৃত।
মানুষ যখন যেখানে যা শুনছেন বা দেখছেন তাই শেয়ার করছে ফেসবুকে। বিনিময় করছেন রাষ্ট্রের সকল বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি।
তাছাড়া, সম্প্রতি আরব বিশ্ব যে ‘বসন্ত’ দেখা দিয়েছে তার উত্থান কিন্তু এই ফেসবুক থেকেই।
এটাও আমাদের উপলব্দি করায় অনলাইনে সংবাদের গুরুত্ব আর জনপ্রিয়তা কিভাবে বাড়ছে।
এর মাঝখানে বলে রাখা ভাল, সম্প্রতি বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকার শাহবাগে যে গণজাগরণ হয়ে গেল তার প্রচার প্রসারে কিন্তু অনলাইন গণমাধ্যম হিসেবে অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে।
যাই হোক, ফেসবুকের মাধ্যমে মিডল ইস্টে পেশাদারীত্বের বাইরে ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ দারুনভাবে চর্চা হচ্ছে।
প্রত্যেকেই নানা ধরণের সংবাদ ফেসবুকে প্রকাশ করছেন, জানছেন এবং প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। এছাড়া আরব বিশ্বে সংবাদের জন্য সবচাইতে জনপ্রিয় আল জাজিরার অনলাইন ওয়েব পোর্টাল।
অন্যসব দেশের মত ভারত-বাংলাদেশেও অনলাইন সাংবাদিকতার বিপ্লব শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের চাইতে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
সংবাদের নতুন মাধ্যম হিসেবে অনলাইনের এই জনপ্রিয়তার অনেক কারণ রয়েছে। সে বিষয়ে আলোচনার আগে একবার ইতিহাসটা পেছন ফিরে দেখতে চাই।
পৃথিবীর সর্বপ্রথম অনলাইন পত্রিকা আসে আমেরিকাতে। ১৯৭৪ সালে ‘নিউজ রিপোর্ট’ নামে পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়।
তারপর নির্দিষ্ট করে কোন ইতিহাস পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় বিশ্বের দ্বিতীয় অনলাইন পত্রিকাটি ১৯৮৪ সালে ব্রাজিলে প্রকাশিত হয়।
সেই সময় কেউ ভাবতে পারেনি এই মাধ্যমটি মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে পারে অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আজ তাই হতে চলেছে, যা কেউ ভাবেনি আগে।
সারা বিশ্বেই সংবাদের জায়গাটি এখন অনলাইনের দখলে যাচ্ছে। বহিঃবিশ্বের চিত্র আগেই দিয়েছি, এবার আসা যাক বাংলাদেশে। হাতে গুনে ছয় বছরের ইতিহাস অনলাইন সাংবাদিকতার।
বিডিনিউজ২৪ডটকম এদেশের প্রথম অনলাইন পত্রিকা হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০০৭ সালে। এর যাত্রা শুরুর পর থেকেই পাঠকদের কাছে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। আলোচিত হতে থাকে অনলাইন সংবাদ।
আলোচনার হাত ধরেই বাড়তে থাকল এর সংখ্যা।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫০০-এর অধিক ওয়েব পোর্টাল আছে। যে হারে বাড়ছে অনলাইনের সংখ্যা, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনপ্রিয়তাও। যা ভাবিয়ে তুলছে কাগুজে পত্রিকাগুলোকে।
শুধু ভাবিয়ে তুলছে বললে ভুল বলা হবে। বলা যায় অস্থিত্ব রক্ষার প্রশ্নে এই দেশের কাগুজে পত্রিকাগুলোও অনলাইনের পথ বেছে নিচ্ছে।
এরইমধ্যে পাঠকদের চাহিদা অনুধাবণ করে পাঠক ধরে রাখতে প্রথম আলো, সমকাল তাদের অনলাইন পোর্টাল চালু করেছে। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরও বেশ কিছু পত্রিকা।
পাশাপাশি রেডিও-টিভির অস্তিত্বেও হাত দিয়েছে অনলাইন। বাধ্য হয়ে তারাও এখন অনলাইন ওয়েব পোর্টালের দিকে ঝুঁকছে। এরইমধ্যে সময় টিভির অনলাইন বেশ সমাদৃতও হয়েছে।
কার্যক্রম হাতে নিয়েছে একাত্তর টিভিসহ অন্যান্য চ্যানেলগুলোও।
আর প্রায় প্রতিটি এফএম রেডিও ওয়েব সাইটের মাধ্যমে তাদের নানা অনুষ্ঠান, সংবাদ প্রচার করছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রেডিও সম্প্রচারে আসার আগে অনলাইনেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি লাভ করছে।
আর এসব থেকে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ অনলাইনেই।
এখন খতিয়ে দেখা যেতে পারে অনলাইনের এই জনপ্রিয়তার কারনগুলো।
প্রথমেই বলা যায় দিন দিন বাড়ছে অনলাইন ব্যাবহারকারী। মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপে প্রতিদিন বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ নানা প্রয়োজনে অনলাইনে ব্রাউজ করছেন।
আর দৈনন্দিন এসব কাজের ফাঁকে ঢুঁ মারছেন হাতের কাছে পাওয়া অনলাইন নিউজ পোর্টালে।
অনলাইন ব্যাবহারকারী বাড়ছে বাংলাদেশেও। বাড়ছে অনলাইনে সংবাদের পাঠকপ্রিয়তা।
তারপর উল্লেখ্য, সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি-এই তিনের চাহিদা একাই পূরণ করে ওয়েব পোর্টাল। এখানে আছে কাগজের পত্রিকার মত সংবাদ ও ছবি, এখানে আপলোড করা যায় যে কোন সাইজের অডিও এবং ভিডিও ফাইল।
যার ফলে একজন পাঠক একটি ওয়েব পোর্টালে প্রবেশ করে একসাথে সবগুলো সুবিধা ভোগ করতে পারেন। বরং বেশি করতে পারেন।
কারণ এখানে সংবাদ পাওয়া যায় চব্বিশ ঘন্টা, যা তরতাজা।
টিভি চ্যানেলের মত সময় মেইন্টেইন করতে হয় না বলে যে কোন ঘটনার যে কোন সাইজের পূর্ণাঙ্গ ভিডিও এখানে প্রকাশ করা যায়। একইভাবে অডিওর ব্যাপারটিও। আর এটাই মূলত অনলাইন সংবাদপত্রের বিকাশের মুল কারণ।
পাশাপাশি, গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বে সবচাইতে বেশি অনলাইন নিউজ পড়েন মোবাইলে অনলাইন ব্যাবহারকারীরা। এদের মধ্যে আবার প্রায় ৮০ ভাগ তরুন-তরুনী।
আর মোবাইল ব্যাবহারকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে বেশ মজবুত। স্বাভাবিকভাবেই অনলাইন নিউজে এর প্রভাব পড়ছে এবং ভবিষ্যতেও পড়বে।
তাছাড়া অনলাইন নিউজের বৈশিষ্ট্য হলো সহজ সাবলীল ভাষা, বৈচিত্রময় ডিজাইন, যা একজন কম শিক্ষিত পাঠককেও ধরে রাখতে সক্ষম।
তবে সব ভাল’র মন্দ থাকে। মন্দ আছে ওয়েব পোর্টালেও। লাইসেন্স ও গঠনের সহজলভ্যতায় যত্রতত্র বাড়ছে এর সংখ্যা।
মান, বিশুদ্ধতা, নিজস্বতার অভাবে অনেক সময়েই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এই মাধ্যমটি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট অনলাইন নীতিমালা।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- ছাপা পত্রিকা এখনো খবরের জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য উৎস: জরিপ
- অনলাইন গণমাধ্যম এর প্রভাব বাড়ছে
- করোনা: মাঠে থাকা সাংবাদিকরা কতটুকু নিরাপদ?
অনলাইনের আরেকটি জটিলতা বিজ্ঞাপন প্রাপ্তি। আমাদের দেশে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনলাইন নিউজ সম্পর্কে সুষ্পস্ট ধারণা না থাকায় সহজে বিজ্ঞাপন চান না।
এতে বিজ্ঞাপন প্রাপ্তিতে নানা সমস্যায় পড়তে হয় অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে।
তবে আশার কথা হল, চলতি বছরে প্রথমবারের মত বড় বড় বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিজ্ঞাপন প্রদান বাজেটে অন্তুর্ভুক্ত করেছে অনলাইন মিডিয়াকে।
তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাংবাদিকতাও তাল মিলিয়ে চলছে। উন্নত বিশ্বে আজকাল বলা হয়ে থাকে ‘নো কম্পিউটার নো জার্নালিজম’। এই কথার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও।
গবেষকদের ধারণা, আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যেই সাংবাদিকতায় রাজত্ব করবে অনলাইন।
লেখক- লিমন আহমেদ, রাইজিংবিডিতে প্রকাশিত