হাটহাজারী মাদ্রাসা বা আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
হাটহাজারী মাদ্রাসা বা আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলামের ( স্থানীয়রা চেনেন হাটহাজারীর ‘বড় মাদ্রাসা’ হিসেবে) গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অতি দীর্ঘ।
বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসাসমূহের উম্মুল মাদারিস তথা মাদ্রাসা সমূহের জননী হিসেবে পরিচিত হাটহাজারী মাদ্রাসা, ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যতম এবং বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন কওমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত হাটহাজারী মাদ্রাসার আয়তন ৪.৪৩ একর বা ১৭৯২৭ বর্গ মিটার। বর্তমানে প্রায় ১০০ জন শিক্ষক এবং কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে প্রায় ৭ সহস্রাধিক ছাত্র অধ্যায়ন করছে ১২৪ বছরের পুরনো এই মাদ্রাসায়।
দারুল উলুম দেওবন্দের পাঠ্যসূচিতে পরিচালিত দারুল উলূম হাটহাজারী’র শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য রাজনৈতিক চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এই মাদ্রাসায় শিশু শ্রেণী থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত পাঠ্দানের পাশাপাশি আছে হিফয-কুরআন বিভাগ।
শিক্ষাসেবায় অবদানের ফলে আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম বিতর্কহীন ভাবে দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত কওমী মাদ্রাসায় পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, দেওবন্দী সনদ, অ্যাকাডেমিক মানদণ্ড ও খ্যাতির ক্ষেত্রে উপমহাদেশের শীর্ষ দশটি মাদ্রাসার মধ্যে হাটহাজারী মাদ্রাসা একটি , এশীয় গবেষণার জাতীয় ব্যুরোর ২০০৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী।
হাটহাজারী মাদ্রাসা এর ইতিহাস
১৮৯৭ সালে (হিজরী ১৩১৫ সনে) বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রাচীন এ কওমী মাদ্রাসা অস্থায়ী ঠিকানায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরবর্তীতে ১৮৯৯ সালে এই কওমী মাদ্রাসা হাটহাজারী উপজেলার বর্তমান ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়।
১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দে দারুল উলুম মাদ্রাসাই বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসার উৎস।
দেওবন্দে মাদ্রাসার আদলে ১৮৯৭ সালে চট্টগ্রাম দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে কওমী মাদ্রাসার সূচনা ও বিকাশ ঘটে।
এজন্য এ মাদ্রাসাকে উম্মুল মাদারিস বা মাদ্রাসা সমূহের জননী বলা হয়।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি): অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বাতন্ত্র্য
- চুয়েট: যেখানে ডানা মেলে হাজারও শিক্ষার্থীর স্বপ্ন
- চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ: মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক
দেওবন্দের একই লক্ষ্যে, তার চিন্তা-চেতনা ও মূলনীতির অনুসরণে মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর আদেশানুসারে তার প্রিয় অনুসারী ও ছাত্র শাইখুল ইসলাম মাওলানা হাবিবুল্লাহ রহ. এবং তার সাথে মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ, মাওলানা সুফী আজিজুর রহমান এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ রহ. এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্যদিকে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারীকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ কয়েক শত কওমী মাদ্রাসা, মক্তব, খানকা, মসজিদ, ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মাদ্রাসাটির গুরুত্ব
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বেশিরভাগই হাটহাজারীর এই কওমি মাদ্রাসার নির্দেশনা অনুসরণ করে থাকে। একাডেমিক দিক থেকেও দেশে সবচেয়ে বড় এই কওমি মাদ্রাসার গুরুত্ব রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, দুই দশক ধরে বিভিন্ন সরকার বা বড় রাজনৈতিক দলগুলোও হাটহাজারীর এই মাদ্রাসাকে গুরুত্ব দিয়েছে।
ফলে এর একটা রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক সময় দৃশ্যমান হয়েছে।
বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালে লংমার্চ এবং ঢাকা অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিল। সংগঠনটি তখন ১৩ দফা দাবি তুলেছিল।
সেই হেফাজতে ইসলামের আমীর হচ্ছেন আহমদ শফী এবং মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, হাটহাজারীর মাদ্রাসাটি যেমন রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি তাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
মুখপাত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম
১৯৩৫ সাল থেকে প্রকাশিত দারুল উলূম হাটহাজারীর মুখপত্র; ধর্ম ও তাহযীব বিষয়ক সাময়িকী ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম’ সমসাময়িক বিষয়াদি ছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মাসলা মাসায়েল প্রকাশ করে থাকে।
সাধারণ ও শিক্ষিত জনসাধারণের মাঝে সঠিক ইসলামী কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় জ্ঞান ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পৌঁছানোর জন্য দারুল উলূম হাটহাজারীর প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগের তত্ত্বাবধানে ‘মাসিক মুঈনুল ইসলাম’ প্রকাশ করা হয়।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মাসিক মুঈনুল ইসলামের সম্পাদক আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এর প্রচারসংখ্যা সন্তোষজনক।
এ পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন, মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরি, মুফতি জসিম উদ্দিন, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও রশীদ জামিলসহ খ্যাতিমান অনেক লেখক।
এছাড়া বার্ষিক আল মুঈন সাময়িকী প্রকাশ করে এই মাদরাসার প্রকাশনা বিভাগ।
ছাত্র বিক্ষোভ
২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বুধবার জোহরের নামাজের পর মাদ্রাসার মাঠে ছাত্ররা বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
দিনভর হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে ‘সম্মানজনকভাবে’ অব্যাহতি দিয়ে নতুন একজনকে নিয়োগ, শফীর ছেলে আনাস মাদানিকে মাদ্রাসা থেকে অপসারণসহ ৬ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেন মাদ্রাসার একদল শিক্ষার্থী।
দাবিগুলো হল :
- মাওলানা আনাস মাদানীকে অনতিবিলম্বে মাদরাসা থেকে বহিষ্কার করতে হবে।
- ছাত্রদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ সুবিধা প্রদান ও সকল প্রকার হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
- শায়খুল হাদিস আল্লামা আহমদ শফী অক্ষম হওয়ায় মহাপরিচালকের পদ থেকে সম্মানজনকভাবে অব্যাহতি দিয়ে উপদেষ্টা বানাতে হবে।
- উস্তাদদের পূর্ণ অধিকার ও নিয়োগ-বিয়োগকে শুরার নিকট পূর্ণ ন্যস্ত করতে হবে।
- বিগত শুরার হক্কানী আলেমদেরকে পুনর্বহাল ও বিতর্কিত সদস্যদের পদচ্যুত করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুধবার রাতেই আনাস মাদানিকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মজলিশে শুরার বৈঠকে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবারও সকাল থেকে ফের বিক্ষোভ, ভাংচুর করেন একদল বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী। সন্ধ্যায় হাটহাজারী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
তবে এতেও পরিস্থিতি শান্ত না হলে বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে ফের বৈঠকে বসেন হাটহাজারী মাদ্রাসার মজলিশে শুরার সদস্যরা। সেখানে আল্লামা শাহ আহমদ শফী তার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার পাখিয়ারটিলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করা সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম আল্লামা শাহ আহমদ শফী তার শত বছরের জীবনের অর্ধেকটাই পার করেছেন হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায়।
‘আল্লামা আহমদ শফী ১৯৪৬ সালে এই মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৪০৭ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৬ সাল থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের (মুহতামিম) দায়িত্ব পালন করে আসা আহমদ শফী ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মহাপরিচালকের পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
সরে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত ৪০ বছর শিক্ষকতা ও ৩৪ বছর পরিচালকের পদে আসীন ছিলেন।
হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালকদের ( মুহতামিম ) তালিকা
- ১ম মুহতামিম: ১৯০১-১৯৪৩ মোট ৪২ বছর মাওলানা হাবীবুল্লাহ কুরাইশী রহ.
- ২য় মুহতামিম: ১৯৪৩-১৯৮২ মোট ৩৯ বছর মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব রহ.
- ৩য় মুহতামিম: ১৯৮২-১৯৮৬ মোট ৫ বছর হাফেজ মাওলানা হামেদ রহ.
- ৪র্থ মুহতামিম ১৯৮৬-২০২০ মোট ৩৪বছর মাওলানা আহমাদ শফী দা.বা.
এদিকে, সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা্র একদিন পর ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে ১০৩ বছর বয়সে শাহ আহমদ শফী বার্ধক্যজনিত কারণে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
পরদিন হাটহাজারী মাদ্রাসার ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে মসজিদের সামনের কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ধর্মীয় পাণ্ডিত্যের কারণে সমমনা আলেম আর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছে আল্লামা শাহ আহমদ শফী ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র।
তবে বহু মতে বিভক্ত বাংলাদেশের কওমি ধারাগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে পারা ছিল তার বড় কৃতিত্ব।
এর মধ্য দিয়েই বাংলায় ১৩টি এবং উদুর্তে ৯টি বইয়ের রচয়িতা এই আলেম হয়ে উঠেছিলেন দেশের কওমি ধারার আলেমদের শীর্ষ নেতা।
শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
মাদ্রাসা চালাতে ৩ সদস্যের কমিটি
দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় আপাতত একক কোনো মহাপরিচালক নিযুক্ত করা হবে না। এর পরিবর্তে তিনজনের একটি পরিচালনা কমিটি করা হয়েছে।
আহমদ শফীর দাফনের দিনেই হাটহাজারীর এই মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছে শূরা কমিটি; আর হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী ফিরেছেন ‘প্রধান শায়খুল হাদিস’ হয়ে।
এই কমিটির তিন সদস্য হলেন- মুফতি আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ আহমদ ও মাওলানা মো. ইয়াহিয়া। এদের মধ্যে শেখ আহমদ গত জুনে হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক পদ পেয়েছিলেন।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
- কর্ণফুলী নদী: হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের অমর সাক্ষী!
- ভাসানচর: আমূল বদলে যাওয়া এক দ্বীপের গল্প!
২০২০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় শূরা কমিটির এই সভা হয়। শূরা কমিটির ১১ সদস্যের মধ্যে আটজন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ।