চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন। মসজিদটির খ্যাতি রয়েছে দেশ-বিদেশে । জাপানের ‘এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও স্থান পেয়েছে মসজিদটির ছবি।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চকবাজার ওয়ার্ডের সিরাজ-উদ-দৌলা সড়কে চন্দনপুরায় হামিদিয়া তাজ মসজিদের অবস্থান। দেশ-বিদেশে খ্যাতি রয়েছে মসজিদটির।
চট্টগ্রামের আইকনিক ছবি হিসেবে এই দৃষ্টিনন্দন মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয়ে থাকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের বিভিন্ন প্রকাশনায়।
এছাড়া, জাপানের ‘এশিয়া ট্রাভেল ট্যুরস’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদেও মসজিদটির ছবি ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রায় ১৫০ বছরের বেশি আগে নির্মিত ঐতিহাসিক ‘চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ’ অপরিকল্পিত সংস্কারকাজে ফলে স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে।
মসজিদের মোতাওয়াল্লি সুত্রে জানাযায়, সূক্ষ্ম কাজের কারিগরের অভাবে সংস্কার কাজও সঠিকভাবে করা যায় না।
বৈরি আবহাওয়ায় এসব জিনিস যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি সংস্কারের সময়ও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে।
সাধারণত দিনে গড়ে কয়েক শত লোক নামাজ পড়েন এই মসজিদে। শুক্রবার তা হাজার ছাড়িয়ে যায়। তখন মসজিদে জায়গা সংকুলান না হলে রাস্তা বন্ধ করে সেখানেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা।
হামিদিয়া তাজ মসজিদ বা মসজিদ ই সিরাজ উদদৌলা
চট্টগ্রামের অনন্য স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন ঐতিহ্যবাহী চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ বা মসজিদ ই সিরাজ উদদৌলা যা চন্দনপুরা মসজিদ হিসেবেই পরিচিত।
মোগল স্থাপত্য নকশার আদলে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। কারুকাজ দেখে সহজেই অনুমান করা যায় এটি মোগল স্থাপিত্যশৈলীর আদলে তৈরি।
মসজিদটির প্রতিটি অংশে সবুজ, নীল, হলুদ, সাদা, গোলাপীসহ হরেক রঙ ব্যবহার; লতা-পাতার নকশা আর নানান কারুকাজে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুনিপুণ হাতে।
ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটির অবস্থান ইসলামের প্রবেশদ্বারখ্যাত চট্টগ্রামের দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসার পূর্ব পার্শ্বে নবাব সিরাজ উদদৌলা সড়ক লাগোয়া।
ইতিহাস
ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খানের সেনাবাহিনী আরাকান মগরাজাদের কবল থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করলে এখানে মোগল শাসন কায়েম হয়।
তখন শাহি ফরমান বলে বিজিত অঞ্চলে অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সে সময়কার হামজা খানের মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ, অলি খাঁ জামে মসজিদ অন্যতম।
বাংলায় মোঘল শাসনামলে এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও মূলত ব্রিটিশ শাসনামলে এ মসজিদের প্রথম সংস্কার করেন মাস্টার হাজী আব্দুল হামিদ।
মসজিদে ঢুকতে কার্নিশে খোদাই করে লিখা আছে নামটি।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- অলি খাঁ মসজিদ: মোঘল স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন
- চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ: মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক
- পরীর পাহাড়ে চট্টগ্রাম আদালত ভবন, অনন্য স্থাপত্যকীর্তি!
জানা যায়, মোগল স্থাপনা শিল্পের আদলে ১৮৭০ সালে মাটি ও চুন সুরকির দেওয়াল আর টিনের ছাদের মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুল হামিদ মাস্টার।
তখনও মাটির দেওয়ালে কারুকাজে ভরপুর ছিল।
তার বংশধর বৃটিশ সরকারের ঠিকাদার আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৪৬ সালে এই মসজিদের সংস্কার কাজে হাতে দেন। এতে সেই সময়ে প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকারও অধিক খরচ হয়।
স্থাপত্যশৈলী
চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ অনেকের কাছে আবার চন্দনপুরা বড় মসজিদ বা তারা মসজিদ নামেও পরিচিত। এখন মসজিদটির বয়স ১৪৯ বছর।
ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়ে পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালের দিকে মসজিদের প্রথম সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয়।
আর সে সময় সংস্কার কাজের জন্য লহৌ থেকে আনা হয় মোগল ঘরানার কারিগর।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে মসজিদ নির্মাণের জন্য নানা উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল।
মসজিদটির নান্দনিকতা বাড়াতে নির্মাণ করা হয় ১৫টি গম্বুজ। মসজিদের সুউচ্চ মিনার, দেয়াল, দরজা-জানালা থেকে শুরু করে সব কিছুতেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সূক্ষ্ম কারুকাজ।
জনশ্রুতি আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গম্বুজ নির্মাণে ব্যবহার করা হয় প্রায় ১০ টন পিতল।
এক সময় পিতলে নির্মিত সুউচ্চ প্রকাণ্ড গম্বুজটি সূর্যালোকে ঝলমল করত। তবে এখন সেই নান্দনিকতা নেই।
স্থাপত্য শিল্পে তাক লাগানো এই মসজিদের আয়তন তিন গণ্ডার মতো।
মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদের গম্বুজের চারপাশে আহলে বায়তে রাসূলসহ আশারায়ে মোবাশশারা তথা দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম লেখা।
এ ছাড়া মসজিদটিতে রয়েছে দুর্লভ ইসলামী নিদর্শনাবলির সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা।
যখন মাইকের ব্যবহার ছিল না তখন মসজিদটির চার তলা সমান উঁচু মিনারে উঠে আজান দেয়া হতো।
বর্তমানে মাইকে আজান হলেও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ মিনার ও আজানখানা।
রাজপথে চলাচলকারী পথিকেরও একনজর দেখে নেওয়ার সুযোগ হয় কালের সাক্ষী এ মসজিদটি।
তবে দীর্ঘদিনের পরিবেশ ও বায়ুদূষণের কারণে মসজিদটির নান্দনিকতা দিন দিন ম্লান হচ্ছে। মিনার ও গম্বুজ হারাচ্ছে ঔজ্জ্বল্য।
তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।