চীনের মতো অন্য কোন দেশের একবিংশ শতকে এতটা উত্থান হয়নি। বিশ্বায়নের কারণে ব্যাপক সুবিধাপ্রাপ্ত চীন বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার বিপরীতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। যদিও পশ্চিমা গণতন্ত্রকে গ্রহণ করার চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে তাদের। কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উদারতার কারণেই গত চার দশকে চীনের এতটা উত্থান সম্ভব হয়েছে।
কয়েক দশক আগেও চীনকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল পৃথিবী। এখন পুরো পৃথিবীকেই বদলে দিতে চলেছে দেশটি। পরাশক্তি আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে চীন।
তা বুঝতে পেরেই হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ বিশ্বকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলায় চীনাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এখন বাণিজ্য।
এই সময়টাতে চীন পশ্চিমা বিশ্বকে ব্যাপক ও গভীরভাবে অধ্যায়ন করেছে। বিশেষ করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার মূলনীতি এবং চর্চার বিষয়গুলো তারা খতিয়ে দেখেছে।
তারা যেটা শিখেছে, সেটা শুধু তাদের দেশকেই বদলে দেয়নি, বরং গোটা বিশ্বকেই বদলে দিয়েছে।
আধুনিক চীনকে দেখার জন্য আদর্শ উদাহরণ হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ।
প্রকল্পটাকে যত সুবিশালই দেখাক না কেন, চীনের দিক থেকে এটা পুনর্গঠনের শুরুর ধাপ – উন্নত সড়ক উন্নত জীবনের দিকে নিয়ে যাবে।
চীনে এখনও অনেক মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, সে কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তাদের অবকাঠামো নির্মাণের প্রচেষ্টার কারণ বোঝা যায়।
এটা কারোর নজরের বাইরে নেই। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব মিডিয়া, কাতারের আল-জাজিরা, চীনের সিসিটিভি, রাশিয়ার আরটি এই চ্যানেলগুলোর দর্শকদের মধ্যে বহু মিলিয়ন আমেরিকান নাগরিকও আছেন।
একটা সম্ভাব্য অনুসিদ্ধান্ত এটা হতে পারে যে, সমৃদ্ধির পথযাত্রা শুধু উদার গণতন্ত্রের পথেই আসে না।
কিন্তু চীনের উত্থানের অর্থ এটা নয় যে, বেইজিং তাদের আদর্শ ও সামাজিক সিস্টেম অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। অথবা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার জন্য নতুন কোন মডেলও তারা তৈরি করছে না।
চীন তাদের কোমল শক্তির প্রসার বাড়াচ্ছে এবং কনফুসিয়াস ইন্সটিটিউটের মাধ্যমে তারা চীনা সংস্কৃতি ও ভাষা ছড়িয়ে দিচ্ছে। বৃটেনের বৃটিশ কাউন্সিল বা ফ্রান্সের অলিয়েস ফ্রঁসেস দীর্ঘদিন ধরে যেটা করছে, তার চেয়ে এটা ব্যতিক্রমী কিছু নয়।
বিশ্বজুড়ে চীন এর ছড়ানো প্রকল্প
মিসরে মরুভূমির মতো একটি এলাকায় নির্দয় তপ্ত সূর্যের নিচে ভূমি জরিপ করছে অন্তত এক ডজন চীনা। তারা এই স্থানটিকে মিসরের নতুন প্রাণকেন্দ্র বানাতে চান। ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে একটি বিশাল প্রকল্পের কাজ হতে চলেছে এখানে।
একটি মিসরীয় কোম্পানির কাছ থেকে এই কাজটি করার চুক্তি করেছে চীন। চীনা ব্যাংকগুলো এই কাজের অর্থায়ন করবে। এখানে অন্তত ২১টি আকাশচুম্বী দালান নির্মিত হবে। বলা হচ্ছে, এসব ভবনের অন্তত একটি আকার আকৃতির দিক থেকে আমেরিকার একসময়ের গর্ব অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংকেও ছাড়িয়ে যাবে। মিসরের মরুভূমিতে চীনাদের এই শ্রম এবং বদান্যতা তাদের বৈশ্বিক আকাক্সক্ষার একটি উদাহরণ মাত্র।
কম্বোডিয়ার বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অর্ধেকই আসে সাতটি বাঁধ থেকে। অর্থের বিনিময়ে এই বাধগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে চীন। দক্ষিণ আফ্রিকা একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের কাছ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পায়। সারা পৃথিবীজুড়ে এমন ৬৩টি শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছে চীন।
আরও পড়ুন – ‘To-Let’ এর শহর চট্টগ্রাম কি ভবিষ্যতের ভুতুড়ে নগরী?
৫০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি ফুটবল মাঠ নির্মাণ করতে চায় জাম্বিয়া। এটি নির্মাণ করার জন্য ইতিমধ্যেই চীনের কাছে তারা ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা চেয়েছে।
এর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে চীন এমন ছয় শতাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এসব অর্থায়নের মাধ্যমে দেশটি অসংখ্য নতুন বন্ধু এবং এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। চীনাদের অর্থায়ন এবং নির্মাণ প্রকল্প চালু আছে বাংলাদেশেও।
এ পৃথিবী বানিয়েছে চীন
পৃথিবীজুড়ে ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো খাতে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির স্বপ্ন দেখে চীন। আর এর মধ্য দিয়েই তারা আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন এবং ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক বিনির্মাণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে পেইচিং-এর আরও কাছে নিয়ে আসাই চীনের লক্ষ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপিয়ান দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেওয়া মার্শাল পরিকল্পনা আমেরিকাকে সামরিক এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে স্থায়ী মিত্র তৈরি করতে সহায়তা করেছিল।
তবে, চীনের পরিকল্পনাকে আধুনিক যুগের মার্শাল পরিকল্পনা বললেও ভুল হবে না। কারণ তাদের পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত, আরও ব্যয়বহুল এবং অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণও বটে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৬০০ প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে চীন। অন্তত ১১২টি দেশ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছে।
এই সহায়তার ক্ষেত্রে কখনো অনুদান, কখনো ঋণ, আবার কখনো বিনিয়োগ আকারে অর্থায়ন করেছে দেশটি। এই সহায়তা পাওয়া দেশগুলো স্বাভাবিকভাবে চীনের প্রতি আনুগত্য দেখাবে।
মজার ব্যাপার হলো, এই দেশগুলোর বেশিরভাগকেই চীন সেইসব প্রকল্পে অর্থায়ন কিংবা ঋণ দিয়েছে যেগুলো তাদের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত।
চাঁদের উল্টোপিঠে চীনের নভোযান: যেভাবে মহাকাশ অভিযানে সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চীন চাঁদের যে অংশটি পৃথিবী থেকে কখনোই দেখা যায় না, সেই দূরবর্তী দিকে এই প্রথম একটি রোবট চালিত মহাকাশযান নামিয়েছে চীন।
চীনের মহাকাশযান চাঙ-আ ৪ চন্দ্রপৃষ্ঠে সফলভাবে অবতরণ করেছে বলে দাবি করছেন চীনা বিজ্ঞানীরা। এটিকে চীনের মহাকাশ কর্মসূচীর জন্য এক বিরাট সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে।
চাঙ-আ ৪ চাঁদের দূরবর্তী দিকের যেখানে ভূমি স্পর্শ করে, সেটি ‘সাউথ পোল এইটকেন বেসিন’ নামে পরিচিত। চাঁদ গঠিত হওয়ার একেবারের শুরুর দিকে বিরাট কোন সংঘর্ষের ফলে সেখানে এই বিশাল গর্ত তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
চীনের মহাকাশ কর্মসূচীর বয়স বেশি নয়। ২০০৩ সালে চীন প্রথম মনুষ্যবাহী মহাকাশযান পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার পর তারা হচ্ছে তৃতীয় কোন দেশ যারা মহাকাশ কর্মসূচীতে এরকম সাফল্য দেখালো।
আগামী কয়েক বছরে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাকাশ টেলিস্কোপ ও বিশ্বের সবচেয়ে ভারী রকেট উৎক্ষেপণ এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মতো নিজেদের মহাকাশ স্টেশন বসানোর পরিকল্পনা করছে।
ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য
চীনের প্রয়োজন বন্ধু। আর সত্যিকারের সেতুই পারে এমন একটি বন্ধু তৈরি করতে। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সঙ্গে তেল এবং বাণিজ্যের জন্য পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়ার অবস্থান চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দেশগুলোতে বড় বড় বন্দর তৈরি করলে সরবরাহ ব্যবস্থা আরও দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে।
প্রতিবেশী দেশগুলোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে চীন। ফলে এসব দেশে সম্প্রসারিত ও সুপ্রশস্ত রাস্তা নির্মাণে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে দেশটি। কিন্তু এটিও চীনেরমহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত।
আলাদা কৌশল
পশ্চিমা সরকার এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সাধারণত রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশগুলোতে কোনো প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে অনীহা দেখায়। চীন এক্ষেত্রে বেশ ব্যতিক্রম। তারা এই ধরনের পরিস্থিতিকে খুব বেশি পাত্তা দেয় না। ভেনেজুয়েলা, নাইজেরিয়া এবং জিম্বাবুয়ের মতো রাজনৈতিক অস্থিতিশীল দেশগুলোকেও দেদার ঋণ দেওয়াই এর প্রমাণ।
যে পথ গড়ে তুলছে চীন
চীনের এক মহাপরিকল্পনার নাম ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো- এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৭০টি দেশের সঙ্গে চীনের মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করা।
এই প্রকল্পের দুটি অংশ। একটি হলো সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট, অন্যটি সমুদ্রগামী মেরিটাইম সিল্ক রোড। প্রথমত সড়কপথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। সড়ক পথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও সংযুক্ত করছে চীন।
প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে দেশটি। প্রাচীন সিল্ক রুট প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিনিময় হয়েছে।
আরও পড়ুন – সীমান্ত মাঝির বুক ফাটা আর্তনাদ!
চীনের নতুন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’-এর আওতায় নতুন নতুন ও উন্নততর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রসার হবে। ফলে এই বেল্টের সঙ্গে যুক্ত থাকা সব দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।
‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর মানচিত্রে দেখা যায়, চীনের সিয়ান থেকে উরুমকি, তুরস্কের ইস্তান্বুল এবং ইউরোপে স্পেনের মাদ্রিদ পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে, যা মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান হয়ে মস্কো, পোল্যান্ড, জার্মানির হামবুর্গ, হল্যান্ডের রটারডাম হয়ে মাদ্রিদে গিয়ে শেষ হবে।
এছাড়াও চীন একটি সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মহাপরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করছে। সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগর, প্রশান্ত সহাসাগর, ভারত মহাসাগর এক সুতায় বাঁধা পড়বে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এটা সেই প্রাচীন সমুদ্র ও সড়কপথের সিল্ক রোড পুনরুদ্ধারের প্রয়াস, যে রাস্তা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল। মহা এই চ্যালেঞ্জ ঘিরেই চীনের যত অর্থনৈতিক কূটনীতি।
বস্তুত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর আওতায় চীন দুটো ‘ইকোনমিক করিডর’ সৃষ্টি করছে। একটি কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ।
দ্বিতীয়টি, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের খাসগর থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত রেল ও সড়ক পথ।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য মহাসাগর অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেল এ পথে খুব অল্প সময়ে চীনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে তার ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-কক্সবাজার-কলকাতা সড়কপথ নির্মাণ করতে হবে। এটি নির্মিত হলে বাংলাদেশ সড়কপথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। এতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে।
নতুন পরাশক্তি
সময়টা তখন ১৯৮৪ সালের শরৎ। পৃথিবীর এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যখন আমেরিকার নতুন সূর্যোদয়ের ঘোষণা দিচ্ছেন পৃথিবীর অপরপ্রান্তে থাকা চীন তখন কয়েক দশকের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। সে সময় চীনের বিভিন্ন অঞ্চল উন্নতি করা শুরু করলেও দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমায় অবস্থান করছিল। কিন্তু এ সবই এখন তাদের দুঃসময়ের স্মৃতি।
তিন দশকের ব্যবধানে পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। তাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এখন চীন। যে পৃথিবী নির্মাণ করে চলেছে চীন তা বাস্তবায়ন হলে অদূর ভবিষ্যতে তারাই হবে পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি। চীনের শক্তিশালী হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কেউ কেউ দাবি করেন, ২০১৪ সালেই অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে চীন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে চীনের জিডিপি ছিল ১৭ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ শতাংশ। জিডিপিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেলেও মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেশটির চেয়ে অনেক পেছনে আছে চীন। তবে, ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে চীন। ধারণা করা হচ্ছে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ২০২০ সালের মধ্যে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে মার্কিন মুদ্রা ডলারকে ছাড়িয়ে যাবে।
আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে চীন। সে সময় উভয় দেশের জিডিপি হবে ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তৃতীয় কোনো দেশ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারেকাছে নেই। অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তির মতো প্রায় সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রকে তীব্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে চীন।
নতুন পরাশক্তি হয়ে উঠতে চীনের সামরিক বাহিনীকে কোনো ভূমিকাই রাখতে হয়নি বলা যায়। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে সম্পর্ক গড়ছে। এই যেমন দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন।
এই মহাদেশে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছে তারা। একটি গরিব দেশকে কয়েক দশকের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত করাটা খুব সহজ কাজ ছিল না। অত্যন্ত দক্ষ ও শিক্ষিত কর্মী বাহিনী দিয়ে তারা উৎপাদন ও বাণিজ্যে অন্যদের হারিয়ে দিয়েছে।
আমেরিকাকে মোকাবেলায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে চীন
আমেরিকাকে মোকাবেলার জন্য পরমাণু সক্ষমতা সম্পন্ন অত্যাধুনিক চারটি বিমানবাহী রণতরী নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে চীন। ২০৩৫ সালের মধ্যে ছয়টি বিমানবাহী রণতরী পানিতে নামবে এবং এর মধ্যে চারটির পরমাণু সক্ষমতা থাকবে বলে চীনের বিশেষজ্ঞরা সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, রণতরীগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহৃত ইএমএএলএস (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক এয়ারক্রাফট লাঞ্চিং সিস্টেম) ব্যবস্থা সজ্জিত হবে। এতে ডিজেলচালিত পুরনো জাহাজের চেয়ে দ্রুত যুদ্ধবিমান পাঠানো যাবে।
বর্তমানে ‘লায়নিং’ নামে চীনে মাত্র একটি ডিজেলচালিত বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ২০১২ সালে ইউক্রেন থেকে অর্ধনির্মিত অবস্থায় এটি কিনেছিল চীন। এটি বিমানবাহিনীর ক্রুদের প্রশিক্ষণের জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অবশ্য এটি আপগ্রেড করে পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করা হবে। লক্ষ্য ভারতের নিজস্ব ক্যারিয়ার নির্মাণের সাথে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ করতে সহায়তা করা।
চীনের প্রথম বিমানবাহী রণতরী টাইপ-০০১এ এখনো সমুদ্রে পরীক্ষামূলকভাবে রয়েছে। নভেম্বরে নৌবাহিনীর ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষে এপ্রিলে এটি চালু হতে পারে।
অন্যদিকে মার্কিন নৌবাহিনীর রয়েছে ১১টি পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী। এছাড়া আরো নয়টি জাহাজ আছে যেগুলো যুদ্ধের সময় রণতরী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চীনা সামরিক পরিকল্পনাকারীরা এই ফাঁকটি বন্ধ করতে আগ্রহী। এখানে অর্থ কোনো বিষয় নয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ উভয় অর্থনীতির ক্ষতি করছে।
চীনের সাবেক কর্মকর্তা ও নৌযুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ওয়াং ইউনফি বলেন, ‘বেইজিংকে যুক্তরাষ্ট্রের একই স্তরের একই পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছা দরকার। অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব থাকলেও নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ যেন চলতে থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা সামরিক ব্যয়কে সমন্বয় করতে পারি।’ তিনি মনে করেন, নতুন ট্যাংকের উৎপাদন কমানো সম্ভব।
হংকংভিত্তিক সামরিক বিশ্লেষক সং জংপিং বলেন, ‘চীনের প্রযুক্তি শিগগিরই মার্কিন জঙ্গিবিমান ও রণতরীর সমান হবে। কিন্তু তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এসব উন্নততর হার্ডওয়্যার শুধুমাত্র ‘ছবির অংশ’। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, চীনা সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ও ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। কারণ চীনা সৈন্যরা আমেরিকার মতো যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি।’
গোলযোগপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে কোনো কোনো দ্বীপের ওপর চীনের সার্বভৌমত্বের দাবির বিরোধিতা করছে আঞ্চলিক এক বা একাধিক দেশ। আমেরিকা এসব দেশকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছে। জানুয়ারিতে মার্কিন নৌবাহিনী তাইওয়ান প্রণালীর মধ্য দিয়ে দু’টি যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল যা নৌবাহিনীর অনুশীলনের স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা হয়েছিল। পরে চীন একটি নতুন মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে। ‘গুয়াম কিলার’ হিসেবে পরিচিত এই মিসাইল মার্কিন দ্বীপের এলাকা বা প্রশান্ত মহাসাগর বা চীন সাগরের কোনো মার্কিন যুদ্ধজাহাজকে আঘাত করতে সক্ষম।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য যুদ্ধে এগিয়ে চীন
চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে এক বছর ধরেই। দফায় দফায় শুল্কারোপ করেও ক্লান্ত হচ্ছে না কোনো পক্ষই। দমাতে চাইলেও নানা কারণে এ যুদ্ধে এগিয়ে থাকছে চীন। তাছাড়া শক্তিশালী অভ্যন্তরীন ভোক্তা বাজার থাকায় এ সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠছে দেশটি।
গত এক বছর ধরেই চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অপরের পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। চীনারা যুক্তরাষ্ট্রে বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে পণ্য বিক্রি করছে এমন অভিযোগে শুল্ক যুদ্ধের শুরুটা হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই। কিন্তু বাস্তবে চীনা রপ্তানিকারকদের চেয়ে বেশি শুল্ক গুণতে হচ্ছে মার্কিন আমদানিকারকদের।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের গবেষণায় বলা হচ্ছে, মার্কিন আমদানিকারকদের চীন থেকে আনা মোবাইল ফোনের ওপর ৮২ শতাংশ, ল্যাপটপে ৯৪ শতাংশ, তিন চাকার যান বা স্কুটারের ওপর ৮৪ শতাংশ এবং খেলাধুলার সরঞ্জামাদির ওপর ৯৮ শতাংশ শুল্ক গুণতে হচ্ছে। এর বদলা নিতে গত মে মাসে চীনের ৩ হাজার কোটি ডলারের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত আরো ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।
তবে, অবাক করা বিষয় হলো এমন শুল্ক যুদ্ধের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বেড়েছে ১২ শতাংশ। শুধু তাই নয়, দিন দিন বিশ্ব বিনিয়োগকারিদের ভরসাস্থলে পরিণত হয়েছে চীন। বিশ্বব্যাংকের বরাত দিয়ে ম্যাককিনসি গ্লোবাল ইন্সটিটিউট নামক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এখন দেশটির গাড়ি ও মোবাইল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছে। চীনের অভ্যন্তরীন বাজার শক্তিশালী হওয়ায়, বিনিয়োগকারিরা এ সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ।
গত এক বছর ধরে দফায় দফায় আলোচনায় বসেও সমাধান হচ্ছে না এ সংকটের। গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, দ্রুত এ বিরোধ মীমাংসা না হলে বিশ্ব অর্থনীতিকেও এর মাশুল গুণতে হবে।
লেখকঃ মসরুর জুনাইদ, সম্পাদক – সিটিজি টাইমস .কম।