চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি, অনেকেই এটাকে ইংরেজ কবরস্থান বললেও প্রকৃতপক্ষে এখানে নির্মল ছায়ায় ঘুমিয়ে আছে মুসলিম, বৌদ্ধ, হিন্দু, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকরা।
‘চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি’ পুরো এলাকায় জুড়ে বিরাজ করছে নীলে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিস্থল এ ওয়ার সিমেট্রিকে নীল পাহাড় আলাদা সৌন্দর্য এনে দিয়েছে ।
চারদিকে ছায়াঢাকা পাখিডাকা সুনশান নীরবতা। যেদিকে চোখ যায় পটে আঁকা ছবির মতো সাজানো গোছানো।
ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া এ চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি’কে দেওয়া হয়েছে নান্দনিক রূপ।
কোথাও আকাশছোঁয়া আকাশমণি, দেবদারু, কড়ই, সেগুন, কৃষ্ণচূড়া ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ঝাড়বেড়া, বাগানবিলাস আর চেনা-অচেনা রকমারি পাতাবাহার, শোভাবর্ধনকারী বৃক্ষরাজি ও ফুলের গালিচা দেখলেই মন ভরে যাবে সবার।
কোথাও হিজল-জারুল-চম্পা, কোথাও সোনালী ফুলের গাছ উঁকি মারছে। মাঝে সারি সারি কবর।
আবার সারি সারি বাহারি ফুলের মেলা। ফুটে আছে লাল, সাদা আর হলুদ লেনটানা, কেরিঅপসিস, রঙ্গন।
ফুলে ফুলে টইটম্বুর গাছগুলো শোভা বাড়াচ্ছে। সৃষ্টি করছে নৈসর্গিক পরিবেশ।
যেখানে সকাল, দুপুর আর বিকেলে আলোছায়ার খেলায় ঘন ঘন রুপ পাল্টে যায়।
পাহাড়ের ভাঁজে অপরূপ এক সমাধিস্থল। এলাকাটি দেখতে অনেকটা নীলাভ মনে হবে। এজন্য অনেকে এ স্থানকে নীল পাহাড়ের দেশ বলেও অভিহিত করেন।
বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ‘চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি’
কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি চট্টগ্রাম হচ্ছে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশনের একটি সৌধ। যা পরিচিতি পেয়েছে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি নামে।
দুই বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা রাজকীয় ব্রিটিশ ফোর্সের প্রায় ১৭ লাখ নিহত সদস্যের স্মৃতি রক্ষার্থে গড়ে ওঠা এ সংগঠন ১৫০টি দেশে প্রায় ২৩ হাজার স্থানে সমাধি ও স্মৃতিসৌধ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত।
কমিশন নিহত প্রতিটি সদস্যের তথ্য সংরক্ষণ করে, যা তাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে দেখা যায়।
স্যার ফেবিয়ান ওয়্যার নামে ব্রিটিশ রেড ক্রসের এক কর্মকর্তার নিরলস চেষ্টার ফসল এ কমিশন। বাংলাদেশে তিনটি সমাধি পরিচালনা করে সিডব্লিউজিসি।
তার মধ্যে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি অবস্থান নগরীর প্রাণকেন্দ্রে জিইসি, প্রবর্তক, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চারুকলা ইনস্টিটিউটের কাছেই ওয়ার সিমেট্রির অবস্থান। ঠিকানা: ১৯ বাদশা মিঞা চৌধুরী সড়ক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইন্দো-বার্মা রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ ফৌজের আক্রমণে মিত্রবাহিনীর যেসব সৈনিক প্রাণ হারায় তাদের সমাহিত করা হয় চট্টগ্রামের এ নীলাভ প্রাকৃতিক পরিবেশে।
বাদশা মিয়া রোডে ফিনলে গেস্ট হাউজের প্রাচীরঘেঁষে সিমেট্রি গেটে পৌঁছে, ৩-৪ মিনিট হেঁটে গ্রিলঘেরা সবুজ চত্বর অতিক্রম করে সমাধিস্থলের মূল ফটক।
প্রবেশ পথের পাশেই বোর্ডে পরিষ্কার করে করণীয় ও বর্জনীয় কার্যাবলির তালিকা দেয়া আছে, যেন এ সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা রক্ষা করা যায়।
এখানে ঢুকতে কোনও টিকিট কাটার ঝক্কি নেই। বিনামূল্যেই উপভোগ করবেন অনাবিল আনন্দ, মন ভরে যাবে শুদ্ধতার পরশে। তবে আপনাকে যেতে হবে সকাল ৮টা থেকে ১২টা বা বেলা ২টা থেকে ৫টার মধ্যে।
তবে, গেট বন্ধ থাকা অবস্থায় খোলার জন্য দয়া করে অনুরোধ করবেন না।
সিমেট্রির ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়বে পাশাপাশি শায়িত পাঞ্জাব-২ রেজিমেন্টের দুই সৈনিক অমর সিং আর গুলাম মোহাম্মদের সমাধি।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- পরীর পাহাড়ে চট্টগ্রাম আদালত ভবন, অনন্য স্থাপত্যকীর্তি!
- কিংবদন্তির ‘চেরাগী পাহাড়’ আছে কেবল নামেই
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
একজনের সমাধিফলকে হিন্দি আর অন্যজনের উর্দুতে স্বজনরা জানিয়েছেন অন্তিম শুভেচ্ছা। ভিন্ন ভাষা আর ভিন্ন ধর্ম মৃত্যুর পরও ভাঙতে পারেনি তাদের বন্ধুত্ব।
ইতিহাস
সময়টা ১৯৩৩ সাল। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাডলফ জেল খেটেছেন। এবার তিনি ভীষণ সতর্ক। উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব নেই।
তবে গায়ের জোরে নয়, কথার জাদুতেই জার্মানদের ভোলালেন চ্যান্সেলর হিটলার।
যেহেতু হিটলারের আগ্রাসী মনোভাবের ফলে জার্মানরা পোল্যান্ড আক্রমণ করে।
এরপর ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান আক্রমণ করল পার্ল হারবার। বেধে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
পার্ল হারবারের পর জাপানিরা মালয়-সিঙ্গাপুর দখল করে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) দিকে এগোতেই নড়েচড়ে বসলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা। রেঙ্গুনের পতনের পরপরই ব্রিটেনের ঘাঁটি উঠে আসে চট্টগ্রামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তির অধীন। তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীসহ মিত্রবাহিনীর অনেক সৈন্যকে অংশ নিতে হয়েছিল এ যুদ্ধে।
যার বেশির ভাগেরই আর রণাঙ্গন থেকে ফেরা হয়নি। চিরকালের মতো স্থান হয়ে গেছে চট্টগ্রামের মাটিতে।
প্রাথমিকভাবে ৪০০ সদস্যের সমাধি নিয়ে শুরু, পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি’তে সমাধির সংখ্যা ৭৩১-তে পৌঁছে।
কারণ, বিশ্বযুদ্ধের পরে অতিরিক্ত মৃতদেহ লুসাই, ঢাকা, খুলনা, যশোর, কক্সবাজার, ধোয়া পালং, দোহাজারি, রাঙ্গামাটি, পটিয়া এবং অন্যান্য অস্থায়ী সমাধিস্থান থেকে এই সমাধিস্থানে স্থানান্তর করা হয়।
ইউনিট আর পদবির ব্যবধান ঘুচিয়ে একই আকার, আকৃতির সমাধিফলকে উত্কীর্ণ রয়েছে প্রত্যেকের নাম, রেজিমেন্ট আর দেশের নাম।
পরবর্তী সময়ে কিছু কিছু সমাধিফলকে নিহত সদস্যের পরিবারের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে পবিত্র কোরআনের আয়াত, বাইবেল থেকে নেয়া বাণী অথবা প্রিয় কবিতার পঙিক্তমালা সংযুক্ত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি’র সমাধিফলকে ৭১৫ জনকে চিহ্নিত করা আছে, বাকিদের পরিচয় জানা যায়নি।
চারপাশে বড় বড় গাছে ঘেরা এ সুনসান সমাধিস্থলের প্রবেশপথ থেকে শেষের প্রার্থনা ঘর পর্যন্ত দুদিকে সারি সারি সমাধিফলকে ৫২৪ সৈনিক, ১৯৮ বৈমানিক আর ১৩ জন নাবিকের শেষ চিহ্ন রয়েছে।
নিহতদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭৮ জন যুক্তরাজ্যের নাগরিক, ২১৪ জন অবিভক্ত ভারতের ও ৯০ জন পশ্চিম আফ্রিকার।
এছাড়া এখানে কানাডা, পূর্ব আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিলান্ডসহ অন্যান্য দেশের নাগরিক রয়েছেন।
আছে সে সময়কার শত্রুপক্ষ জাপানের ১৯ জন সৈন্যের মৃতদেহ।
প্রবেশ পথের ডান পাশে ছোট একটি কক্ষে সংরক্ষিত রেজিস্টারে ১৯৩৯-৪৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সাগরে মৃত্যুবরণ করা নাবিক ও লস্করদের নাম রয়েছে।
দেশের সেবায় সলিল সমাধি বরণ করে নেয়া ইন্ডিয়ান রয়্যাল নেভি ও ইন্ডিয়ান মার্চেন্ট নেভির প্রায় ৬ হাজার ৫০০ সদস্যের স্মরণে ‘চিটাগং/বোম্বে ১৯৩৯-১৯৪৫ ওয়ার মেমোরিয়ালস’ নামের দুটি রেজিস্টারের অন্য কপিটি ভারতের মুম্বাইয়ে অবস্থিত ইন্ডিয়ান সিম্যান হোমে রক্ষিত আছে।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি’তে ব্রিটেনের রয়াল আর্টিলারির ২৪ বছর বয়সী গানার জে এফ হ্যালিডের সমাধির ফলকে তার প্রেয়সী লিখেছিলেন- আমি তোমার অপেক্ষায় জেগে থাকব।
এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) চট্টগ্রাম-বোম্বের একটি স্মারক বিদ্যামান রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালীন সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং ব্রিটিশ জেনারেল হাসপাতালের সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে মিত্র বাহিনী চতুর্দশ সেনাবাহিনীর এই পথিকৃৎ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
কোনো রকম বসার জায়গা, খাবারের ব্যবস্থা, হকার ও ভিক্ষুকবিহীন, ডিএসএলআর ক্যামেরামুক্ত পরিবেশে মনকে স্থির করে শুধু নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে আগ্রহী হলেই আপনার যাওয়া উচিত সিডব্লিউজিসির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এ সমাধিক্ষেত্রে।
যেতে পারেন যেভাবে-
যেকোন জেলা থেকে সহজেই চট্টগ্রাম যাওয়ার জন্য বাস সার্ভিস রয়েছে। আর ঢাকা থেকে বাস এবং ট্রেন যোগে সহজেই চট্টগ্রাম যেতে পারেন।
শহর থেকে চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি বেশি একটু দূরে নয়, চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায় ১৯নং বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কে অবস্থিত।
মেডিকেল কলেজ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, অথবা ফিনলে গেস্ট হাউসের কাছে পাহাড়ি ঢালু আর সমতল ভূমিতেই ওয়ার সিমেট্রি চট্টগ্রাম।
প্রবেশের সময়সুচি
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি প্রায় চার একর জায়গাতে অবস্হিত।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পযর্ন্ত এবং বিকেলে ২টা থেকে ৫টা পযর্ন্ত সাধারণ দশর্নার্থীদের জন্য প্রবেশে উন্মুক্ত থাকে ।
ওয়ার সিমেট্রি মূল গেট দিয়ে ঢুকতে একটি নোটিশ বোর্ড দেখতে পাবেন। তাতে সাধারণ দর্শনার্থীদের কিছু তথ্য দিয়া আছে একটু দেখতে হবে।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চুনতি অভয়ারণ্য: এশিয়ান হাতির প্রজননক্ষেত্র
- ঐতিহ্যবাহী গুমাই বিল: চট্টগ্রামের শস্য ভাণ্ডার
- কালুরঘাট সেতু: ঐতিহ্যের স্মারক হালুরঘাডর পোল!
তবে দুই ঈদের তিনদিন করে বন্ধ থাকে ওয়ার সিমেট্রি। চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি দেখাশোনা একজন তত্ত্বাধায়কের অধীনে পাঁচজন কর্মকর্তা আছে দেখাশোনার জন্য ।
তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।