আন্দরকিল্লা মসজিদ: মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক

Posted by

ঐতিহ্যের স্মারক ও ধারক আন্দরকিল্লা মসজিদ; চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারক হিসেবে শিলালিপিভিত্তিক যেসব স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের শিলালিপি অন্যতম।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ

ছানিয়ে কাবা হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামে মোগল বিজয়ের স্মারক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। জুমা মসজিদ হিসেবেই সবার কাছে বেশি পরিচিত।

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ৩৫২ বছর ধরে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের এই ঐতিহাসিক মসজিদ।

আরাকানি মগ এবং পর্তুগীজ জলদস্যূদের বিরুদ্ধে মুঘলদের জয়লাভের স্মারক হিসেবে ‘আন্দরকিল্লা মসজিদ’ নির্মাণ করা হয়।

চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক ইসলামি স্থাপনা চাটগছার আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদের সঙ্গে মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনি সম্পর্কিত।

এ কেল্লায় এক সময় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল বলে কথিত আছে।

১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রামের তৎকালীন মোগল শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এ কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করলে তখন থেকে এর নাম হয় ‘আন্দরকিল্লা’।

সময়ের সাথে এটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান হয় উঠেছে।

বর্তমানে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ধর্মীয় ইবাদতের পাশাপাশি মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলী উপভোগ করার জন্য আন্দরকিল্লায় ভিড় করেন।

ইতিহাস

আব্দুল করিম বিদ্যাবিশারদ তার ‘ইসলামাবাদ’ শীর্ষক গ্রন্থে পর্তুগীজ ও মগদের বিরুদ্ধে মুঘলদের বিজয় এবং আন্দরকিল্লা মসজিদ এর নির্মাণকাজের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন।

ওই গ্রন্থে আন্দরকিল্লাকে তিনি বন্দরনগরীর সবচেয়ে পুরানো মসজিদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ওই গ্রন্থানুসারে, শায়েস্তা খার সুবেদারি আমলে চট্টগ্রাম ছিল আরাকান মগ এবং পর্তুগীজ জলদস্যূদের দখলে।

তারা চট্টগ্রাম শাসন করলেও প্রায়শ বাংলার ভেতরে প্রবেশ করে লুটপাট চালাতেন।

এসব ব্যাপারে তিতিবিরক্ত হয়ে শায়েস্তা বাংলার মাটি থেকে আরাকান মগ ও পর্তুগীজদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেন।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৬৬৫ সালে তৎকালীন আরাকানদের ঘাটি চট্টগ্রামে সামরিক অভিযান শুরু করেন।

সামরিক অভিযান পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় শায়েস্তা খার বুজুর্গ উমেদ খানকে।

এটা ছিল এমন একটা সময় যখন পর্তুগীজদের সাথেও আরাকানরা বিবাদে লিপ্ত ছিল।

তাই যুদ্ধ শুরুর পর পর্তুগীজরাও পরে মুঘল সেনাদের সাথে হাত মেলায়। ফলে আরাকানদের খুব সহজেই বিতাড়িত করতে সক্ষম হয় মুঘল বাহিনী।

১৬৬৬ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে চট্টগ্রাম সম্পূর্ণ দখলে নেয় মুঘলরা।

তারা চট্টগ্রামের নাম রাখেন ইসলামাবাদ। উমেদ খানকে ইসলামাবাদের প্রথম ফৌজদার হিসেবে মনোনীত করা হয়।

পরবর্তীতে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব যুদ্ধে বিজয়ের স্মারক হিসেবে পাহাড়ের চূড়ায় একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন বুজুর্গ উমেদ খানকে।

সেই নির্দেশ মোতাবেক ১৬৬৭ সালে নির্মিত হয় আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।

আন্দরকিল্লা মসজিদ এর স্থাপত্যশৈলী

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ

মোঘল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী তৈরি হয়েছে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মসজিদটি দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের আদলে তৈরি।

আর সেই একই রীতিতে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে এই মসজিদটি নির্মিত হয় বলে একে ‘পাথরের মসজিদ’ও বলা হয়ে থাকে।

মসজিদের নির্মাণ শৈলী সম্পর্কে জানা যায়, সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে ছোট একটি পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ। প্রস্থ ৭ দশমিক ৫ গজ (৬.৯ মিটার)।

প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২ দশমিক ৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু।

পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মসজিদটির পূর্বে তিনটি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে।

মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মধ্যখানের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এটির চারপাশের দেয়াল আড়াই গজ প্রস্থ বিশিষ্ট।

মসজিদের পশ্চিম দিকের দেয়াল নান্দনিক টেরাকোটা সমৃদ্ধ। অন্য তিন দিকের দেয়ালগুলো পাথরের তৈরি। মসজিদটির ছাদে তিনটি গম্বুজ মসজিদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

মোঘল ঐতিহ্যের স্মারক

“হে জ্ঞানী, তুমি জগতবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে”। এটি হচ্ছে সেই ঐতিহাসিক ফারসী শিলালিপির বাংলা অনুবাদ। যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি (১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দ)।

ঐতিহ্যের স্মারক ও ধারক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে এ শিলালিপি স্থাপিত রয়েছে।

গবেষকগণ জানান, প্রাচীন এই মসজিদের সব শিলালিপির সঙ্গে সিরিয়ার ‘রাক্কা নগর’ এর স্থাপত্যকলার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

বর্তমানে শিলালিপিটি মূল মসজিদের একপ্রান্তে বসানো অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে।

সেই সময়ে মসজিদের মূল ইমারতের প্রবেশপথে কালো পাথরের গায়ে খোদাই করা সাদা অক্ষরে লেখা ফারসী শিলালিপিটি বসানো হয়েছিল।

শুধু স্থাপত্য নিদর্শনই নয় স্থাপত্য অনন্য শৈল্পিক দিক থেকেও মসজিদটি এ অঞ্চলের এক অনন্য পুরাকীর্তি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।

ঐতিহাসিকদের মতে, এখানে চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারক হিসেবে শিলালিপিভিত্তিক যেসব স্থাপনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের শিলালিপি অন্যতম।

মোঘল শাসকের চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।

চট্টগ্রামের অনন্য এক ঐতিহাসিক স্থাপনা এ মসজিদ। প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছরের পুরানো এ মসজিদ কালের সাক্ষী।

আদি চট্টগ্রামের অস্তিত্ব ও নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

মোঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনী জড়িয়ে আছে এ আন্দরকিল্লার সঙ্গে।

মসজিদ দখল ও পুনরুদ্ধারের ইতিহাস

বৃটিশ শাসনামলে মসজিদটিকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা মসজিদটির গম্বুজ ও কয়েকটি পিলার ভেঙে ফেলে।

১৭৬১ সাল থেকে ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯৪ বছর তারা এই মসজিদে কোনো ধরনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে দেয়নি।

পরবর্তীতে এর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন তৎকালীন বৃটিশ রাজের অধীনস্ত রাজস্ব কর্মকর্তা খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান।

তার এই আন্দোলনের মুখে ১৮৫৬ সালে আন্দরকিল্লা মসজিদ পুনরায় চালু হয়।

প্রয়োজন সংরক্ষণের

এমন একটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে ইতিহাসবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর শামসুল হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, “আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হলেও আন্দরকিল্লা মসজিদ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমরা অমূল্য এক সম্পদ হারাবো।”

পুরাতত্ত্ব বিভাগে আঞ্চলিক পরিচালক বলেন, “চট্টগ্রামের প্রাচীন অবকাঠামোগুলোকে চিহ্নিত করতে জরিপ চালানো হচ্ছে। এটি শেষ হলেও চিহ্নিত ভবনগুলোকে সংরক্ষণে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদ
১৯ বছর ধরে আন্দরকিল্লা মসজিদ সুবিশাল ইফতার আয়োজন

চট্টগ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আগ্রহে ধারাবাহিকভাবে এই ঐতিহাসিক মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন রাসূল (সা:)-এর আওলাদগণ।

১৯৯৬ সাল থেকে এ আন্দরকিল্লা মসজিদ-এ খতিবের দায়িত্ব পালন করছেন আওলাদে রাসূল (সা:) মাওলানা ছাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন তাহের জাবেরী আল মাদানী।

ঐতিহ্যবাহী জুমা মসজিদের খতিবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০১ সাল থেকে ১৯ বছর ধরে এখানে আয়োজন করা হচ্ছে ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন সুবিশাল ইফতার আয়োজন।

বর্তমানে রমজানের শেষ দশকে দৈনিক প্রায় ৩ হাজার রোজাদারের একসাথে ইফতার আয়োজন করা হচ্ছে।

ধনী-গরিবের বৈষম্যহীন ইফতারে নগরীর নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সেখানে সৃষ্টি হয় সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য পরিবেশ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিয়মিত ইফতারসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে খেজুর, শরবত, ছোলা, মুড়ি, জিলাপি, আলুর চপ, ছমুছা, অন্থন, পেঁয়াজু ইত্যাদি।

এছাড়া মাঝে মধ্যে মওসুমি ফল এবং থাকে বিরিয়ানিও। গত মঙ্গলবারও নিয়মিত ইফতারির পাশাপাশি আয়োজন ছিল বিরিয়ানির।

৩ হাজার মানুষের ইফতার আয়োজনের বিশাল কর্মযজ্ঞ সামালে নিয়োজিত রয়েছেন ১০ জন বাবুর্চি। আর ইফতার বণ্টন কাজে নিয়োজিত আছেন ১৫ জন কর্মচারী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা।

এখানে ইফতার করতে আসা লোকজনের মধ্যে সমাজের নিন্মবিত্ত মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষরাও রয়েছেন।

রয়েছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, স্বল্প আয়ের মানুষ, ভিক্ষক, চাকরিজীবী এবং বড় ব্যবসায়ীরাও। অনেক বিত্তবানরা সাথে নিয়ে আসনে নানা ধরনের ইফতারসামগ্রীও।

আসরের নামাজের পর হতেই সারিবদ্ধভাবে রোজাদাররা সুশৃঙ্খলভাবে বসে পড়েন ইফতারের জন্য।

আর মাইকে পেশ করা হয় ইসলামী মাসয়ালা-মাসায়েল সম্পর্কিত ওয়াজ নসিহত। ইফতারের পূর্বে সমবেত হাজারো রোজাদারের সম্মিলিত মুনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

উল্লেখ্য, মসজিদ কমিটির দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার মুসল্লি এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন। জুম্মার দিন এই সংখ্যা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮ হাজারে। বর্তমানে মসজিদ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে জানা যায়, ১৬৬৭ সালে এ মসজিদ নির্মাণের পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে আন্দরকিল্লা মসজিদ তীর্থস্থান হয়ে উঠে।

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ইমাম বা খতিব নিযুক্ত হতেন পবিত্র মদিনার আওলাদে রাসূলগণ। তখন রোজা, ফিতরা এবং ঈদের চাঁদ দেখার প্রশ্নে এ মসজিদের ফয়সালা চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণ মেনে চলতেন।

এ জামে মসজিদে প্রতি জুমার দিনে চট্টগ্রাম ও এর আশপাশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুসল্লিরা এসে নামাজ আদায় করতেন। পবিত্র মাহে রমজানের শেষ জুমায় কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকেও মানুষের সমাগমের নজির রয়েছে।

বিদাতুল জুমায় ২০ হাজার মানুষ হয়। বর্তমানে আন্দরকিল্লা মসজিদ-এ ৩ জন ইমাম, ২ জন মুয়াজ্জিন ও ৬ জন খাদেম রয়েছেন।

তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।

মতামত দিন