‘কানামাছি’ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিশুতোষ লোকজ খেলা

Posted by

কানামাছি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিশুতোষ লোকজ খেলা। এই খেলা কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেলেও এখনো চোখে পড়ে কোথাও কোথাও।

কানামাছি
গ্রাম বাংলার কানামাছি খেলার দৃশ্য

হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য যেমন পুরনো ও সমৃদ্ধ তেমন আমাদের দেশের খেলাধুলাও বৈচিত্র্যপূর্ণ।

বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা ধরনের মজাদার খেলাধুলা; যা শুধু খেলাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে দেশীয় আচার ও ঐতিহ্যকেও ধরে রেখেছে সমান ভাবে।

আমাদের লাগামহীন শৈশবের স্বাধীনতায় ছিল না কোনো গণ্ডি। দুরন্তপনার ক্ষেত্র ছিল অবারিত। সেই সময়ের শৈশব আর এ সময়ের শৈশবের পার্থক্য ঢের।

যান্ত্রিকতা এবং আধুনিকতা আমাদের জীবন থেকে অনেক কিছুই মুছে দিচ্ছে। আধুনিক যুগে শিশুদের শৈশব যেন খাঁচায় থাকা ছটফটে চড়ুই পাখির মতো, প্রাণ আছে কিন্তু সেই প্রাণে আনন্দের লেশ নেই।

এই প্রজন্মের অনেকে জানেই না তারা কি হারাচ্ছে আর তারা কি পাচ্ছে! যে সময়টা তাদের কাটার কথা খেলার মাঠে সেই সময়টাতে তারা হয় হাতে মোবাইল বা ভিডিও গেমস নিয়ে ব্যস্ত।

এক সময় “কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ”- বিকেল বেলায় এই ছড়া মাতিয়ে রাখতো খেলার মাঠ, বাড়ির উঠোন কিংবা বাড়ির পিছনের বাগান।

কানামাছি বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই জনপ্রিয় একটি শিশুতোষ লোকজ খেলা। এই খেলায় সুরে সুরে এই কথাগুলো বলতে শোনা যায় প্রত্যেককেই।

শৈশবের এই মজার খেলাটিও এখন হারানোর লিস্টে জমা হচ্ছে। কানামাছি যখন খেলা হয় তখন বাচ্চাদের হুল্লোড় খিলখিল শব্দে জায়গাটা মুখর হয়ে উঠে। দৌড়া দৌড়ি তো আছেই।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

গ্রামাঞ্চলে শহরের বাতাস লাগাতে সেখান থেকেও এখন এমন মজার খেলাটি যাই যাই করছে। এখন খুব কমই এই খেলার দেখা মেলে গ্রাম বাংলায়।

কানামাছি খেলাটি ‘ব্লাইণ্ড বি’ নামে ইউরোপেও প্রচলিত। দাসপ্রথায় অপরাধীর অন্যতম শাস্তি ছিল চক্ষু তুলে অঙ্গহানি করা; পরে তাকে শারীরিকভাবে উত্যক্ত করা। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে, কানামাছি খেলার উদ্ভবে এর ছায়াপাত থাকতে পারে।

কানামাছি খেলার নিয়মকানুন

কানামাছি ভোঁ ভোঁ
কানামাছি খেলার দৃশ্য, Image Credit: Ferdousi Begum

শুধু এক টুকরো কাপড় আর কিছুটা জায়গা হলেই চলে লোকজ খেলা ‘কানামাছি’ খেলতে; কোনো সরঞ্জাম লাগে না।

এমনকি মাঠ, ছাদ বা ঘরের মধ্যেও খেলতে কোনো সমস্যা হয় না।  ‘কানা’ যে হবে তাকে একটু হাঁটাহাঁটি করার যায়গা করে দিতে পারলেই হয়।

কানামাছির ‘কানা’ মানে কিন্তু আসল কানা নয়। দিব্যি চোখে দেখতে পাওয়া একজন মানুষ।

তবে, কানামাছি খেলায় অন্তত পক্ষে তিনজন খেলোয়াড় লাগে। একজন ‘কানা’ আর দুইজন সাধারণ খেলোয়াড়। তবে ১০-১২ জন বা তার বেশি খেলোয়াড় থাকলেও কোন সমস্যা হয় না।

“কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যারে পাবি তারে ছো” এই ছড়াটি বলেই মুলত খেলাটি খেলা হয়ে থাকে। এই মজার খেলার শুরুতেই টস করে একজনকে বেছে নিয়ে কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা হয়। চোখবাঁধা ব্যক্তিকেই বলা হয় কানামাছি।

কানামাছির ‘কানা’ যেন দেখতে না পায় তাই তার চোখ একটা রুমাল বা কাপড়ের টুকরা দিয়ে বাধা হয়। বন্ধন এমন হয় যাতে সে চোখেও দেখে না আবার চোখে ব্যথাও না পায়। মানে হলো খুব শক্তও না আবার হালকাও না।

চোখ বাধার পরে একজন ‘কানা’র চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে জিজ্ঞেস করে কতগুলো আঙ্গুল আছে। এভাবে বুঝতে হয় সে দেখতে পাচ্ছে নাকি অথবা কতটা দেখতে পাচ্ছে। ধরো তখন যদি কেউ দেখেও না দেখার ভাব করে সেটাও বুঝে ফেলা যায়।

চোখ বেঁধে কানা বানিয়ে ফেলার পরে শুরু হয় আসলে খেলা। তখন কানাকে ( খেলোয়াড়) এলোমেলো ঘুরিয়ে দিয়ে বাকিরা চারিদিকে ছড়িয়ে পরে।

কানার কাজ হলো অন্যদের খুঁজে বের করে স্পর্শ করা। চোখ বাধা অবস্থায় কানা বাকি খেলোয়াড়দের ধরতে চেষ্টা করে।

বাকি খেলোয়াড়েরা তার চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘিরে থাকে ও কানামাছি ছড়া বলতে বলতে তার গায়ে টোকা দেয়।

এ সময় অন্য খেলোয়াড়রা কানার কাছ থেকে বাচতে এদিক ওদিক দৌড়ায় সেই আওয়াজে কানা ঠিকই টের পায় কে কোথায় আছে।

আবার মজা করতে অন্য খেলোয়াড়রা একটু দূরে গিয়ে কানাকে ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে খুশি তাকে ছোঁ’ ছড়া কেটে ডাকও দেয়। কানা সেদিক দৌড় দেয়।

তখন চোখবাঁধা ব্যক্তিটিও ছড়া কাটতে থাকে ‘আন্ধা গোন্ধা ভাই,আমার কোনো দোষ নাই’। দৌড়াদৌড়ির মধ্যে সে যদি কাউকে ধরতে পারে এবং তার নাম বলতে পারে তবে তার জায়গায় নতুন খেলোয়াড় কানা হয়।

এভাবে একের পর এক কানামাছির পরিবর্তন হয় কিন্তু সুর ও ছন্দ অপরিবর্তনীয়ই থাকে। যাকে ছোঁয়া হয়েছে সে নতুন ‘কানা’ এখন তার চোখ বাধা হবে আর যতক্ষণ সে অন্য কাউকে না ছুঁতে পারবে একই পদ্ধতিতে খেলা চলতে থাকবে।

যতক্ষণ খেলোয়াড়রা ক্লান্ত হয়ে খেলায় ক্ষান্ত না দিচ্ছে।

মতামত দিন