জমি কেনার আগে কিছু বিষয়ে অবশ্যই আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে জমি বিক্রেতার মালিকানা এবং জমির বিভিন্ন দলিল ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে; নইলে পড়তে পারেন বিপদে, হতে পারেন প্রতারিত।
জমি কিনতে যাচ্ছেন? জমি কেনার আগে সম্ভাব্য সব যুক্তিসংগত সতর্কতা অবলম্বন ও অনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে।
তা না হলে অনেক সময় জমির দালালদের কথায় প্ররোচিত হয়ে জমি কিনতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ার ঘটনাও দেখা যায়।
জমি কেনার প্রধান পূর্বশর্ত হচ্ছে ক্রেতা হিসেবে আপনাকে সাবধান এবং সচেতন হতে হবে।
হুট করে দলিলপত্রাদি যাচাই না করে জমি কেনা উচিত নয়।
জমি কেনার আগে কী কী যাচাই করা প্রয়োজন:
- জরিপের মাধ্যমে প্রণীত রেকর্ড অর্থাৎ খতিয়ান ও নকশা যাচাই করতে হবে।
- জমির তফসিল অর্থাৎ জমির মৌজা, খতিয়ান নম্বর, দাগ নম্বর উক্ত দাগে জমির মোট পরিমাণ জানতে হবে।
- প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিএস; এসএ; আরএস পরচা দেখাতে হবে।
- বিক্রেতা ক্রয়সূত্রে ভূমির মালিক হয়ে থাকলে তার ক্রয় দলিল বা ভায়া দলিল রেকর্ডের সঙ্গে মিল করে বিক্রেতার মালিকানা নিশ্চিত হতে হবে।
- বিক্রেতা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হলে সর্বশেষ জরিপের খতিয়ান বিক্রেতা বা তিনি যাঁর মাধ্যমে প্রাপ্ত তাঁর নামে অস্তিত্ব (যোগসূত্র) মিলিয়ে দেখতে হবে।
- জরিপ চলমান এলাকায় বিক্রেতার কাছে রক্ষিত মাঠ পরচা যাচাই করে দেখতে হবে।
- উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি বিক্রেতার শরিকদের সঙ্গে বিক্রেতার সম্পত্তি ভাগাভাগির বণ্টননামা (ফরায়েজ) দেখে নিতে হবে
- বিক্রেতার কাছ থেকে সংগৃহীত দলিল, খতিয়ান/পরচা ইত্যাদি কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে গিয়ে তলবকারী /স্বত্বলিপি রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।
- সর্বশেষ নামজারি পরচা ডিসিআর খাজনা দাখিল (রসিদ) যাচাই করে দেখতে হবে। জমির খাজনা বকেয়া থাকলে এবং বকেয়া খাজনাসহ জমি ক্রয় করলে বকেয়া খাজনা পরিশোধের দায় ক্রেতার।
- বিবেচ্য জমিটি সার্টিফিকেট মোকদ্দমা ভুক্ত কি না, কখনো নিলাম হয়েছে কি না, তা তহশিল অফিস / উপজেলা ভূমি অফিস থেকে জেনে নিতে হবে।
- সার্টিফিকেট মামলাভুক্ত সম্পত্তি বিক্রয়যোগ্য নয়।
- বিবেচ্য ভূমি খাস, পরিত্যক্ত/অর্পিত, অধিগ্রহণকৃত বা অধিগ্রহণের জন্য নোটিশকৃত কি না, তা তহশিল, উপজেলা ভূমি অফিস বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এল এ শাখা থেকে জেনে নিতে হবে।
- বিবেচ্য ভূমি কোনো আদালতে মামলা–মোকদ্দমাভুক্ত কি না, তা জেনে নিতে হবে।
- মামলাভুক্ত জমি কেনা উচিত নয়।
- বিবেচ্য জমিটি সরেজমিনে যাচাই করে এর অবস্থান নকশার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে এবং দখল সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে বিক্রেতার মালিকানা ও দখল নিশ্চিত হতে হবে।
- সাব–রেজিস্ট্রারের অফিসে তল্লাশি দিয়ে জমির সর্বশেষ বেচাকেনার তথ্য জেনে নেওয়া যেতে পারে।
- প্রস্তাবিত জমিটি ঋণের দায়ে কোনো ব্যাংক /সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ কি না।
- প্রস্তাবিত জমিতে যাতায়াতের রাস্তা আছে কি না, তা–ও দেখা প্রয়োজন।
এছাড়া, জমি কেনার আগে প্রস্তাবিত জমিটি সরেজমিনে গিয়ে দেখে; সংলগ্ন জমির মালিক বা এলাকাবাসীর কাছ হতে জমির বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে।
এরাই আপনাকে জমির বিষয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারবে।
যেসব টেকনিক্যাল পরিভাষা বা টার্ম আপনার না জানলেই নয়!
একাউন্ট বই বা খতিয়ান: একাধিক গ্রাম বা মৌজা ভিত্তিতে বিভিন্ন জমির মালিকদের যাবতীয় ভূ-সম্পত্তির বিবরণ, তথ্য ও উপাত্ত জরিপ করার সময় এক বা একাধিক যে জমির রেকর্ড তৈরি করা হয় তাকে বলা হয় খতিয়ান।
এতে কালেক্টর বা ভূমধ্যাধিকারীর নাম, দখলদারের নাম, জমির পয়েন্টার বা দাগ নাম্বার, পরিমাণ, ধরণ এবং ট্যাক্সের হার ইত্যাদি সব রকম তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন রকম খতিয়ান বই রয়েছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত সিএস, এসএ এবং আরএস খতিয়ান ইত্যাদি অন্যতম।
সি এস খতিয়ান: ১৯১০-২০ সালের মধ্যে সরকারী কর্মকর্তা বা আমিনরা দেশের প্রতিটি জমি বা ভূ-খন্ড পরিমাপ করেন।
সেই তথ্যের ভিত্তিতে ভু-খন্ডগুলোর আয়তন, ভৌগলিক অবস্থান ও ব্যবহারের ধরণ ইত্যাদি উল্লেখ করে তারা মৌজা নকশা এবং প্রত্যেকটি জমির মালিক কিংবা দখলদারদের বিবরণ সহ সেই আমলে একটি খতিয়ান তৈরি করেন।
সেই খতিয়ানটিই সিএস খতিয়ান নামে পরিচিত।
এস এ খতিয়ান: ১৯৫০ সালে জমিদারি মাইগ্রেশন ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর তখনকার সরকার জমিদারি অধিগ্রহণ করেন।
এরপর সরকারি জরিপ কর্মচারীরা মাঠে না গিয়েই সরেজমিনে সি এস খতিয়ানটি সংশোধন করেন।
এই নতুন খতিয়ানটি এস এ খতিয়ান নামে সুপরিচিত।
কোন কোন অঞ্চলে এই খতিয়ানকে এ খতিয়ান বা এস খতিয়ান নামেও ডাকা হয়।
এই খতিয়ানটি সর্বপ্রথম বাংলা ১৩৬২ সালে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
সেই থেকে অনেকের কাছেই এটি ৬২’র খতিয়ান নামেও পরিচিত।
আর এস একাউন্ট বই: আগের জরিপে উল্লেখিত ভুল ত্রুটি সংশোধনের জন্য পরবর্তীতে আবারও একটি জরিপ করা হয়, যা আর এস খতিয়ান নামে পরিচিত।
দেখা যায় যে এস এ জরিপের ভিত্তিতে খতিয়ান তৈরি করার সময় কর্মচারীরা জমিগুলো পরিদর্শন করেননি ও সরেজমিনে করা তদন্তে অনেক বেশি ভুল ত্রুটি রয়ে গেছে।
সেজন্যই পুনরায় জরিপের মাধ্যমে নতুন খতিয়ানটি প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সারা দেশে এই জরিপ এখনও সমাপ্ত করা হয় নি বটে, কিন্তু অনেক জেলায়ই তাদের নিজস্ব আর এস খতিয়ান চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তারা নিজেরা মাঠে গিয়ে জমিগুলো পরিমাপ করে এই খতিয়ান প্রস্তুত করেন।
যার ফলে সামগ্রিক ভাবে এতে ভুলত্রুটির পরিমাণ অনেক কম।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই খতিয়ানটি বি এস খতিয়ান নামেও পরিচিত।
বি এস একাউন্ট বই: সর্ব শেষ এই জরিপটি ১৯৯০ সালে পরিচালনা করা হয়। রাজধানী ঢাকায় এই জরিপটি ঢাকা মহানগর জরিপ নামেও পরিচিত।
দলিল: যেকোন লিখিত বিবরণ বা জবানি যা আইনত সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে আদালতে গ্রহণযোগ্য তাকে দলিল বলে।
তবে, রেজিস্ট্রেশন আইনের বিধান অনুযায়ী একটি জমির ক্রেতা এবং বিক্রেতা তাদের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তরের সময় যে চুক্তিনামা বা চুক্তিপত্র রেজিস্ট্রি করেন সাধারণ ভাবে সেটিকেও দলিল বলা হয়ে থাকে।
খানাপুরি: খতিয়ান প্রস্তুত করার সময় জরিপ ও তদন্ত করার পর মৌজা নকশা প্রস্তুত করার সময় খতিয়ান ফরমের প্রতিটি কলামের তথ্য পূরণকে খানাপুরি বলা হয়।
জরিপ কর্মচারীরা সমগ্র খতিয়ান ফরমের তথ্য পূরণের এই কাজটি সম্পন্ন করে থাকেন।
নামজারি: ক্রয়সূত্রে কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে, অথবা যেকোন ধরণের সূত্রে যদি কেউ একটি জমির নতুন মালিক হন, তবে সেই মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় নামজারি।
তফসিল: জমির সামগ্রিক পরিচয় বহন করে এমন বিবরণকে তফসিল বলা হয়।
এই তফসিলে মৌজার নাম, খতিয়ানের নাম্বার, দাগ বা পয়েন্টারের নাম্বার, জমির আয়তন বা চৌহদ্দি, জমির পরিমাণ সহ আরো নানা রকম তথ্য উল্লেখ করা থাকে।
দাগ / কিত্তা: একটি জমির অংশবিশেষ বোঝাতে দাগ ব্যবহার করা হয়।
যখন একটি জমি পরিমাপ করা হয়, তখন সেটিকে ওই সময়ের ক্রম অনুসারে একটি বিশেষ পরিচিতি নাম্বার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
জরিপের ম্যাপ প্রস্তুত করার সময় মৌজা নকশায় জমির সীমানা সনাক্ত করার জন্য প্রত্যেকটি ভূ-খন্ডকে আলাদা আলাদা নাম্বার দেয়া হয়।
আর এই নাম্বারকেই আমরা দাগ নাম্বার বা দাগ হিসেবে চিনি।
এক একটি দাগ নাম্বারে জমির পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন থাকতে পারে। সাধারণ ভাবে একই মৌজার অধীনে বিভিন্ন জমি মালিকদের সীমানা দাগ অনুসারে আইল বা খুঁটির সাহায্যে চিহ্নিত করা হয়।
এতে করে জমির প্রত্যেকটি অংশকেই ল্যান্ড গ্রেডের ভিত্তিতে আলাদা করে চেনা সম্ভব হয়। এই দাগকে কোথাও কোথাও ‘কিত্তা’ বলা হয়ে থাকে।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- জেনে নিন কপিরাইট নিবন্ধন করার নিয়মকানুন: ঘরে বসেই ই-কপিরাইট!
- অনলাইনে নিলাম আবেদন চট্টগ্রাম কাস্টমসে, ঘরে বসে অংশ নিন
- হোল্ডিং ট্যাক্স এবং হোল্ডিং নম্বর
ছুটা দাগ: প্রাথমিক অবস্থায় জমির নকশা তৈরি কিংবা পরিবর্তন করার সময়, নকশার প্রতি ভূমি এককে একটি নাম্বার দেয়া হয়। এই নাম্বার দেয়ার সময় কোন নাম্বার ভুলে বাদ পড়ে গেলে বা দেয়ায় ভুল হলে তাকে ছুটা দাগ বলে।
আবার প্রাথমিক পর্যায়ে দেয়া দু’টি দাগ পরবর্তীতে যদি আবার একত্রিত করে পুনরায় সংশোধন করা হয়, তখন যে নাম্বারটি বাদ দেয়া হয় সেটাকেও ছুটা দাগ বলে।
পর্চা: চূড়ান্ত খতিয়ান প্রস্তুত করার আগে জমির মালিকদের কাছে খসড়া খতিয়ানের যে কপি জমি মালিকদের দেয়া হয়ে থাকে তাকে মাঠ পর্চা বলে।
এই মাঠ পর্চাটি রেভিনিউ বা রাজস্ব অফিসারের দ্বারা তসদিব বা সত্যায়িত করানোর পর কারো যদি কোণ আপত্তি থেকে থাকে তাহলে তা শুনানির পরখতিয়ার আবার চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশিত হয়।
আর এই চূড়ান্ত খতিয়ানের কপি কে পর্চা বলা হয়।
চিটা: একটি ছোট জমির পরিমাণ, ধরণ ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণকে চিটা বলা হয়ে থাকে।
বাটোয়ারা বা ভাগের মামলায় প্রাথমিক ডিক্রীকে চূড়ান্ত ডিক্রীতে পরিণত করার আগে অ্যাডভোকেট কমিশনার বাটোয়ারার সব পক্ষদের জমি সরেজমিনে পরিমাপ করে পরামর্শ দেন।
সেই সময় তিনি জমিটির যে খসড়া ম্যাপ তৈরি করেন সেটি চিটা বা চিটা দাগচনামে পরিচিত।
দখলনামা: দখলনামা হচ্ছে দখল বা মালিকানা পরিবর্তন ও হস্তান্তরের সনদপত্র বা সারটিফিকেট।
কোন ক্রেতা একটি প্রপার্টি নিলামে ক্রয় করার পর সরকার পক্ষ ক্রেতাকে তার প্রপার্টির দখল বুঝিয়ে দেয়ার পর একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেন।
সেই সার্টিফিকেটটিকে দখলনামা বলা হয়। সরকারের লোক মাঠ পর্যায়ে যেয়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে, লাল পতাকা বা নিশান উড়িয়ে কিংবা বাঁশের সাইনবোর্ড গেঁথে নতুন মালিককে দখল প্রদান করেন।
কোন ডিক্রী জারি করার ক্ষেত্রে এবং নিলামে যেকোন প্রপার্টি বিক্রয় হলে কখনও কখনও ক্রেতাকে সার্টিফিকেট দেয়ার মাধ্যমে ঐ প্রপার্টির দখল বুঝিয়ে দিয়ে থাকে।
সেই সার্টিফিকেটটিকেও দখলনামা বলা হয়।
যদি কোন ব্যক্তি সরকার কিংবা আদালতের পক্ষ হতে কোন প্রপার্টির দখলনামা পেয়ে থাকেন, তাহলে বুঝে নিতে হবে যে ঐ সম্পত্তির উপর ঐ ব্যক্তিটির দখল রয়েছে।
খাজনা: জমি ব্যবহারের জন্য সরকার বার্ষিক ভাবে দখলদারের কাছ থেকে যে কর আদায় করে থাকেন সেটাকে সেই জমির খাজনা বলা হয়।
বায়নামা: ১৯০৮ সালের দেওয়ানি আইনের কার্যবিধি অনুযায়ী ২১ নাম্বার আদেশের ৯৪ নাম্বার নিয়ম অনুসারে কোন স্থায়ী প্রপার্টি নিলামে বিক্রি চূড়ান্ত ঘোষিত হলে আদালত ক্রেতাকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে।
এতে নিলামকৃত জমি সংক্রান্ত সব রকম বিস্তারিত তথ্য দেয়া থাকে। এই সার্টিফিকেট বা সনদ বায়নামা নামে পরিচিত।
এই বায়নামায় নিলাম ক্রেতার নাম সহ অন্যান্য বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়।
কোন নিলাম বিক্রি চূড়ান্ত হয়ে গেলে সেই ক্রেতার নামে একটি বায়নামা অবশ্যই দিতে হবে।
নিলাম চূড়ান্ত হওয়ার তারিখটি বায়নামায় অবশ্যই উল্লেখ করে দিতে হবে।
জমাবন্দী: জমিদার কিংবা তালুকদারেরা তাদের আমলে প্রজা বা দখলদারের নাম, জমি ও খাজনার বিস্তারিত তথ্য একটি বিশেষ পদ্ধতিতে লিপিবদ্ধ করতেন।
সেই বিশেষ পদ্ধতিকেই জমাবন্দী বলা হয়ে থাকে।
বর্তমানে তহসিল অফিসে একই রেকর্ড বা তথ্য লিপিবদ্ধ করে রাখার পদ্ধতিকেও জমাবন্দী বলা হয়।
দাখিলা: সরকার বা সম্পত্তির মালিককে কোন প্রকার খাজনা দেয়া হলে একটি নির্দিষ্ট ফর্ম বা রসিদ প্রদান করতে হয় (ফর্ম নাম্বার- ১০৭৭)। এই ফর্মটিকে দাখিলা বা খাজনার রসিদ বলা হয়।
যদিও দাখিলা কোন স্বত্ব বা মালিকানার দলিল নয়, তবুওদখল সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রমাণ এতে লিপিবদ্ধ থাকে।
ডিসিআর: জমির কর ব্যতীত অন্য কোন সরকারী পাওনা আদায় করার পর যে নির্ধারিত রসিদ বা ফর্ম (ফর্ম নাম্বার ২২২) দেয়া হয়ে থাকে তাকে ডিসিআর বলা হয়ে থাকে।
কবুলিয়ত: সরকারের পক্ষ হতে কৃষকদেরকে জমি ব্যবস্থা দেয়ার প্রস্তাব প্রজা বা দখলদারের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়।
এরপর সরকার তাদেরকে এই ব্যাপারে একটি অনুমতি বা অঙ্গীকার পত্র দিয়ে থাকেন এবং এটিকেই কবুলিয়ত বলে।
ফারায়েজ: ইসলামী বিধান অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির প্রপার্টি বন্টন করার নিয়ম ও প্রক্রিয়াকে ফারায়েজ বলা হয়ে থাকে।
ওয়ারিশ: ওয়ারিশ শব্দটির অর্থ হচ্ছে উত্তরাধিকারী।
ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী যেকোন ব্যক্তি উইল না করে মারা গেলে তার স্ত্রী, সন্তান কিংবা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে হয়ত এক বা একাধিক ব্যক্তি তার রেখে যাওয়া প্রপার্টির মালিকানা পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে ঐ মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশ বলা হয়।
হুকুমনামা: জমিদারদের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নেয়ার পর প্রজা বা দখলদারের মালিকানা বা দখল প্রমাণ করতে হয়।
আমলনামা বা হুকুমনামা হলো সেই প্রজার স্বত্ব দখল প্রমাণের দলিল।
সংক্ষেপে বলতে গেলে জমিদারের পক্ষ থেকে প্রজা বা দখলদারের কাছে দেয়া জমির বন্দোবস্ত সম্পর্কিত নির্দেশনা পত্রকেই আমলনামা বা হুকুমনামা বলা হয়।
মৌজা: সি এস জরিপ অথবা ক্যাডাস্টল জরিপ যখন করা হয় তখন্থানা ভিত্তিক এক বা একাধিক গ্রাম, ইউনিয়ন, পাড়া, মহল্লা ইত্যাদি আলাদা করে বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করে তাদেরকে ক্রমিক নাম্বার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছেআর বিভক্ত করা এই প্রতিটি ইউনিটকে মৌজা বলা হয়। এক বা একাধিক গ্রাম নিয়ে এই মৌজা গঠিত হয়।
আমিন: জমি জরিপের মাধ্যমে করা নকশা ও খতিয়ান তৈরি করা ও জমি জরিপের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের আমিন বলা হয়ে থাকে।
সিকস্তি: নদী ভাঙ্গনের ফলে যদি কোন বিশেষ জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায় তাহলে তাকে সিকস্তি বলা হয়ে থাকে।
এই সিকস্তি জমি যদি পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে আবারও আগের অবস্থায় ফিরে আসে, তাহলে সিকন্তি হওয়ার সময় জমিটির যে মালিক ছিলেন তিনি কিংবা তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে কেউ শর্তসাপেক্ষে ঐ জমিটির মালিকানা পাবেন।
পয়ন্তি: নদী গর্ভ থেকে পলিমাটির স্তর জমে যদি কোন নতুন জমি সৃষ্টি হয়, তবে তাকে পয়ন্তি বলা হয়ে থাকে।
লেনদেন বাতিলকরণ: এর মানে হলো যৌথ মজুদকে বিভক্ত করে ফেলা এবং সম্পূর্ণ নতুন খতিয়ান তৈরি করা।
সাধারণত প্রজারা জমি লেনদেন কিংবা বাটোয়ারা করার সময় অন্য খতিয়ানের অন্তর্ভুক্ত জমির একটি অংশের সাথে একটি করে নতুন খতিয়ান খোলেন।
এই নতুন খতিয়ান খোলার ঘটনাকে লেনদেন বাতিলকরণ বলা হয়ে থাকে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে মূল খতিয়ান থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জমির জন্য নতুন খতিয়ান তৈরি করাটা লেনদেন বাতিলকরণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
নামজারি ছাড়া কি জমির মালিক হওয়া যায়?
শুধুমাত্র কোনো দলিলের মাধ্যমে অর্জিত মালিকানার ভিত্তিতে অথবা ওয়ারিশ হিসেবে বাবা-মায়ের জমিতে দখলসূত্রে থাকলেই সরকারি রেকর্ডে উক্ত ভূমিতে তাঁর মালিকানা নিশ্চিত হয় না।
কোনো ভূমিতে বৈধ ওয়ারিশ বা ক্রয়সূত্রে মালিক হবার পর পূর্বের মালিকের নাম থেকে নাম কেটে বর্তমান মালিকের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হয়, তাহলেই তার মালিকানা সরকার কর্তৃক নিশ্চিত হয়।
আর এটিই হল নামজারি পদ্ধতি।
আপনি যদি ওয়ারিশ হিসেবে বা ক্রয়সূত্রে কোনো জমির মালিক হন কিন্তু নামজারি না করান, তবে আপনার অজান্তে কোনোভাবে এক/একাধিক দলিল সম্পাদন করে কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি আপনার আগে নামজারি করে ফেলতে পারে।
তাতে আপনি পরবর্তীতে নামজারি করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সমস্যায় পড়বেন।
সাধারণভাবে আমরা অনেকেই মনে করি দলিল সম্পাদন হলেই কাজ শেষ। নামজারির দরকার কী? এটি অত্যন্ত ভুল ধারণা।
দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে শুধুমাত্র মালিকানা হস্তান্তর হয়, সরকারের খাতায় মালিক হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া যায় না।
জমি রেজিস্ট্রেশনের ৮ দিনের মধ্যে নামজারি
মন্ত্রিসভা জমি রেজিস্ট্রেশন ও নামজারি কার্যক্রম সমন্বয়সাধনের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে।
এতে সফটওয়্যার ব্যবহার করে স্বচ্ছতার সঙ্গে জমির রেজিস্ট্রেশন করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামজারি ও রেকর্ড সংশোধন হবে।
জমি রেজিস্ট্রেশন শেষ হওয়ার আট দিনের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামজারি হয়ে যাবে এবং এসিল্যান্ডকে (সহকারী কমিশনার-ভূমি) বাধ্যতামূলকভাবে সেই জমির রেকর্ড সংশোধন করতে হবে।
২০২০ সালের ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আনা এ অনুমোদন দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, এখন থেকে নামজারির জন্য আলাদা কোনো আবেদন করতে হবে না।
আট দিনের মধ্যে নামজারি হয়ে যাবে। এসবের ম্যানুয়াল কপিও দেয়া হবে।
সহজে জাল দলিল চেনার কিছু সহজ উপায়
জমি কেনার আগে সাবধান না হলে পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়।
এমন বহু মানুষ রয়েছেন, জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে আসল দলিল চিনতে না পারায় ঝামেলায় পড়েন। এজন্য দলিল চেনা খুবই জরুরি।
সহজে জাল দলিল চেনার উপায়:
ভলিউডেমর তথ্য: সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলের প্রকৃতি অনুযায়ী চারটি রেজিস্ট্রার বা ভলিউমে লেখা হয়ে থাকে।
কোনো দলিল নিয়ে সন্দেহ হলে রেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষণ করা দলিলের সাল মিলিয়ে দেখতে হবে।
এজন্য নির্দিষ্টভাবে দরখাস্ত করতে হবে। এতে দলিলটির যাবতীয় তথ্য দিতে হবে।
স্বাক্ষর যাচাই: অনেক সময় স্বাক্ষর জালিয়াতি করে দলিলদাতা বা গ্রহীতার সাজা হয়।
এক্ষেত্রে স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করিয়ে নেয়া যেতে পারে।
এছাড়া ভূমি অফিস থেকে বিভিন্ন সিল পরীক্ষা করেও জালিয়াতি নির্ণয় করা যায়।
খেয়াল রাখতে হবে, অনেক আগের দলিলে আগের চিহ্নিত কিছু সিল ব্যবহারই থাকে।
আগের দলিল কিন্তু সিল যদি নতুন হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে, দলিলটি জাল হতে পারে।
একই সঙ্গে তারিখটিও ভালোভাবে যাচাই করতে হবে।
দলিল রেজিস্ট্রির তারিখ কোনো সরকারি বন্ধের দিন থাকলে সন্দেহের অবকাশ থাকবে।
অনেক সময় অর্পিত সম্পত্তি বা মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি জীবিত দেখিয়ে জাল করা হয়।
মূল মালিক শনাক্ত: এক জমির একাধিক মালিকের নামে করা থাকলে ধরে নিতে হবে দলিলটি জাল হতে পারে।
এক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মূল মালিক কে, তা নির্ণয় করতে হবে।
নামজারি: সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে জমির মিউটেশন বা নামজারি সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।
নামজারিতে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি না, সেটা সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
যদি দেখা যায়, সিএস জরিপের সঙ্গে বিক্রেতার খতিয়ানের কোনো গরমিল আছে, তাহলে বুঝতে হবে, কোনো জটিলতা আছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, জরিপ খতিয়ানে জমির পরিমাণ পরবর্তী সময়ে যতবার বিক্রি হয়েছে, তার সঙ্গে জমির পরিমাণ মিল আছে কি না, তা যাচাই করে দেখা।
দাগ নম্বর, ঠিকানা এসব ঠিক আছে কি না, এসব যাচাই করতে হবে।
আমমোক্তারনামা: সম্প্রতি কোনো আমমোক্তারনামা দলিল থাকলে তাতে উভয় পক্ষের ছবি ব্যবহার হয়েছে কি না যাচাই করতে হবে।
তারিখ যাচাই: কোনো দান করা জমি হলে দলিলে সম্পাদনের তারিখ দেখে কবে জমিতে গ্রহীতা দখলে গেছে তা যাচাই করতে হবে।
দলিলটি রেজিস্ট্রি করা কি না এবং দলিলদাতার সঙ্গে গ্রহীতার সম্পর্ক কী, তা যাচাই করতে হবে।
লেখক যাচাই: সম্প্রতি সম্পন্ন হওয়া কোনো বিক্রীত দলিলের দলিল লেখকের নাম ঠিকানা জেনে সরেজমিন কথা বলে নেয়া দরকার।
মালিকানা যাচাই: জমির স্বত্ব কী বা মালিকানা যাচাই করতে হবে।
বিক্রেতার কাছ থেকে সব দলিল, বিশেষ করে ভায়া দলিল চেয়ে নিতে হবে।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জানতে হবে সব দলিলের ক্রমিক নম্বর, দলিল নম্বর ঠিক আছে কি না।
সিল-স্ট্যাম্প যাচাই: দলিল সম্পাদনের সময় ব্যবহৃত স্ট্যাম্পের পেছনে কোন ভেন্ডার থেকে স্ট্যাম্প কেনা হয়েছে এবং কার নামে কেনা হয়েছে খেয়াল রাখুন।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
প্রতিটি স্ট্যাম্পের পেছনে একটি ক্রমিক নম্বর উল্লেখ থাকে।
এ নম্বরটি ঠিক আছে কি না, প্রয়োজনে স্ট্যাম্প বিক্রেতার সঙ্গে দেখা করে যাচাই করে নিন।
তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।
অসাধারণ লেখা মনজুর ভাই। অনেক ধন্যবাদ এমন মূল্যবান তথ্য শেয়ার করার জন্য।