মাইজভান্ডার দরবার শরীফ: শতবর্ষের সুরধারা মাইজভান্ডারী গান

Posted by

মাইজভান্ডারী গান মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এর অনুসারীদের গাওয়া মরমী গান।  বাংলা লোকসংগীতে এক ব্যতিক্রমী ও অভূতপূর্ব ধারা সৃষ্টি করেছে এই গান।

মাইজভান্ডার দরবার শরীফ

মাইজভান্ডার দরবার শরিফ ও মাইজভান্ডার তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) শুধু সুফি সাধক নন; তিনি একটি স্বতন্ত্র তরিকার প্রতিষ্ঠাতা।

কাদেরিয়া তরিকার আলাদা প্রতিষ্ঠিত মাইজভান্ডারী তরিকায়, অন্যান্য তরিকার আধ্যাত্মিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলো একত্র করা হয়েছে।

মাইজভান্ডারী তরিকা কাদেরিয়া সিলসিলার তরিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই, এ তরিকায় বাইয়াত প্রদানের সময় কাদেরিয়া তরিকা অনুসরণ করা হয়।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

হযরত মওলানা শাহ ছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) ১৮২৬ সালে ১৪ জানুয়ারী (১২৩৩ বাংলা পহেলা মাঘ) চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন।

তিনি আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী নামেই বহুল পরিচিত। পারিবারিক নাম ‘সৈয়দ আহমদ উল্লাহ’। এছাড়া তার অনুসারীগণ তাঁকে গাউছুল আজম, হযরত কেবলা, বড় মৌলানা, খাতেমুল অলদ, শাঁই-এ-লিল্লাহ প্রভৃতি উপনামেও ডেকে থাকে।

তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ হামিদ উদ্দিন গৌড়ি ইসলাম প্রচার করতে ১৫৭৫ সালে চট্টগ্রামে এসে পটিয়ায় বসতি স্থাপন করেন।

তাঁর পুত্র সৈয়দ আবদুল কাদের ফটিকছড়ি থানার আজিম নগরে ইমামতির দায়িত্ব নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর প্রপৌত্র মাওলানা সৈয়দ মতি উল্লাহর ঔরসে সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর জন্ম হয়।

১২৬০ হিজরিতে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা গমন, ১২৬৮ হিজরিতে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করেন এবং হাদিস, তাফসির, ফেকাহ ইত্যাদি শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন।

সেখানেই তিনি ইসলামিক নানান অনুষ্ঠানাদিতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে একজন সু-বক্তা হিসাবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

সাথে সাথে ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণায় জড়িত হয়ে পড়েন। হিজরী ১২৬৯ সালে তিনি যশোর জেলায় কাজী (বিচারক) পদে যোগদান করেন।

পরবর্তিতে ১২৭০ হিজরীতে কাজী পদে ইস্তফা দিয়ে তিনি কলকাতায় মুন্সী বু আলী মাদ্রাসায় প্রধান মোদাররেছ হিসাবে যোগদান করেন।

এর অল্প কিছু দিন পরই তিনি আধ্যাত্মিক জীবন যাপনে আত্মনিয়োগ করেন। তখন হতে তিনি বাকি জীবন একজন সুফি সাধক হিসাবে অতিবাহিত করেন।

৭৯ বছর বয়সে ১৯০৬ ক্রিস্টাব্দে ১০ মাঘ ১৩১৩ বঙ্গাব্দ, সোমবার রাতে নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন এ মহান সুফি সাধক।

তার নশ্বর জীবনের শেষ দিকে এলাকার সমাজপতি ও ভক্তদের উপস্থিতিতে তার নিজ পুত্র বংশীয় আদরের নাতি হযরত মাওলানা শাহ্‌ ছুফী সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) -কে নিজ গদী অর্পণে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন।

মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এর যাত্রা 

হযরত মওলানা শাহ‌ ছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) এর পীরে তরিকত ছিলেন শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরী (রহ:)।

বিল আছালত বা স্বভাব সিদ্ধ অলি শাহ‌ ছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) তার পীরে ত্বরিকতের নির্দেশে ১৮৫৭ সালে নিজ গ্রাম মাইজভান্ডারে ফিরে আসেন।

মাইজভান্ডারী তরিকার সপ্ত পদ্ধতি:

  •  ফানা আনিল খালক (আত্মনির্ভরতা)।
  • ফানা আনিল হাওয়া (অনর্থ পরিহার)।
  • ফানা আনিল এরাদা (প্রবৃত্তি প্রস‚ত ইচ্ছার বিনাস)।
  • মউতে আবয়্যাজ (সাদা মৃত্যু)।
  • মউতে আছওয়াদ (কাল মৃত্যু)।
  • মউতে আহমর (লাল মৃত্যু)।
  • মউতে আখজার (সবুজ মৃত্যু)।

কিছুদিনের মধ্যেই তার বুযুর্গীর কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ তার দরবারে ভীড় জমায়। লোকসমাজে পরিচিতি পায় ‘মাইজভান্ডার দরবার শরীফ’ হিসেবে।

ওরশ

ওরশসুফিবাদী আধ্যাত্মিকতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৮, ৯ ও ১০ মাঘ ৩ দিন ব্যাপী ওরশ (১৯০৭ সাল থেকে) অনুষ্ঠিত হয় মাইজভান্ডার দরবার শরীফে।

তিনদিনের এই আয়োজনে থাকে মাজারে গিলাপ চড়ানো, মিলাদ, জিকির ও ছেমা মাহফিলসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা।

এছাড়া ওরশ উপলক্ষ্যে সারা দেশ এবং ভারত পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখো ভক্ত, অনুরাগি ও আশেকানদের পদচারণায় তিনদিন ধরে মুখর থাকে মাইজভান্ডার দরবার শরিফ।

মাইজভান্ডারের এই প্রধান ওরস উপলক্ষে গাউছিয়া আহম্মদিয়া মনজিল, গাউছিয়া রহমানিয়া মনজিল, গাউছিয়া মঈনিয়া মনজিল, গাউছিয়া হক মনজিল, গাউছিয়া হাদি মনজিল, নেজামিয়া মনজিলসহ প্রত্যেক মনজিলে আলোক সজ্জার ব্যবস্থা করা হয়।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লাখো ভক্তের সুবিধার্থে থাকে চট্টগ্রাম থেকে নাজিরহাট পর্যন্ত বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা।

প্রতি বছর দেশের লাখ-লাখ ভক্ত ও মুরিদানরা উট, গয়াল, গরু, মহিষ, ছাগল হাদিয়া, নজর-নেওয়াজ মাইজভান্ডার দরবারে নিয়ে আসে।

বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, বার্মা, ভুটান, মালদ্বীপ থেকেও অনেক আশেক ভক্ত-অনুরক্তরা গরু মহিষ নিয়ে এখানে আসেন।

ওরশকে কেন্দ্র করে মাইজভান্ডার দরবার শরিফ ও কয়েক কিলোমিটার আশপাশের এলাকা জুড়ে বসে গ্রাম্যমেলা।

মাইজভাণ্ডারী গান

মাইজভান্ডারী গানমাওলানা ছৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর প্রতিষ্ঠিত মাইজভান্ডারী তরিকার অন্যতম অপরিহার্য অংশ হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মাইজভান্ডারী গানের উদ্ভব ঘটে। 

মাইজভান্ডারী গান বা মাইজভান্ডারী মরমী গান বাংলা লোকসংগীতে এক ব্যতিক্রমী ও অভূতপূর্ব ধারা, যা একান্তই চট্টগ্রামের নিজস্ব সম্পদ।

মাইজভাণ্ডারী গানের একটি বিশেষত্ব আছে। বাংলা গানের হাজার বছরের পরিক্রমায় যে সব গান সৃষ্টি হয়েছে তাদের রচয়িতার মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তাদের সে ধারার গানের রচনা শৈলীরও যবনিপাত ঘটেছে।

কিন্তু মাইজভাণ্ডারী গান যে ধারায় রচিত তা একটু ব্যতিক্রম।

মাইজভাণ্ডারী তরিকার যারা প্রবর্তক তাঁরা কেউ এ ধরনের গান লিখে যান নি। বরং তাঁদের আশেক বা ভক্তগণই তাঁদের গুণগান, কীর্তি, মহিমা বর্ণনা করে গান রচনা করেছেন এবং এই ধারা আজো প্রবাহমান।

মাইজভাণ্ডারী গানের এটা একটা অনন্য সাধারণ ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য।

এছাড়া, মাইজভাণ্ডারী গানে স্রষ্টার বদলে পীরের মাহাত্মই মুখ্য (সূত্র-চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা-আবদুল হক চৌধুরী)।

মাইজভাণ্ডার নামক একটি গ্রাম থেকে এই গান ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার একটি অতি সাধারণ গ্রাম থেকে এই গান যেভাবে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে গেছে তা সত্যি বিস্ময়কর।

এই গানের ছটুল তাল, লয়, ছন্দ গানে এক ধরণের দারুণ আবহ সৃষ্টি করে, যা সহজেই শ্রোতাদের মনযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম।

মাইজভাণ্ডারী গানের এই ক্রমবিকাশমান ধারায় এবং সারা বিশ্বে তার আবেদন ছড়িয়ে দেবার পেছনে তিনজন অন্যতম দিকপালের নাম অগ্রগণ্য। তাঁরা হলেন মওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, কবিয়াল রমেশ শীল ও আবদুল গফুর হালী।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

এরমধ্যে  মওলানা হাদীকে মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভাবক বলা হয়, হাদীর সংগীত রচনার সময়কাল হলো ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ।

রমেশ শীল মরমী ধারায় মাইজভাণ্ডারী গানের সংযোজক, মাইজভাণ্ডারী গানে রমেশ শীলের সময়কাল বিংশ শতাব্দীর বিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত।

আর আবদুল গফুর হালী হলেন মাইজভাণ্ডারী গানে নবযুগের স্রষ্টা।  গফুর হালীর গানটি উদ্ধৃত করা হলো :

দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতেছে নুরের খেলা

নুুরী মাওলা বসাইল প্রেমের মেলা॥

আল্লাহু আল্লাহু রবে নানান বাদ্য শোনা যায়

গাউছুল আজম শব্দ শুনে আশেকগণে হুঁশ হারায়

জিকিরেতে আকাশ বাতাস করে আল্লাহু আল্লাহ॥

(আবদুল গফুর হালী, সুরের বন্ধন)

যতদূর জানা যায়, শতাব্দীকাল ধরে শতাধিক গীতিকারের প্রায় ৫ সহস্রাধিক মাইজভাণ্ডারী গান বাংলার লোকসংগীতের ধারাকে ঋদ্ধ করেছে।

এ পর্যন্ত ১১৮ টি মাইজভাণ্ডারী গানের বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার মধ্যে ৮৬টি বইয়ে গানের সংখ্যা ৪৪৮৮টি।

এ ছাড়া পাণ্ডুলিপি সংগৃহীত হয়েছে পাঁচটি, যাতে গান রয়েছে ৩২৮টি।

সব মিলিয়ে সংগৃহীত গানের সংখ্যা ৪৮১৬টি। (সূত্র-আঞ্জুমানে মোত্তাবিয়ানে গাউছে মাইজভাণ্ডারী সাংস্কৃতিক পরিষদ)।

এই গানের প্রথম গীতিকার কে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

তবে ১৩৬৫ বাংলা সনে ‘আল মাইজভাণ্ডারী’ পত্রিকায় মৌলবী বজলুর রহমান বিএবিটি ‘মাইজভাণ্ডারী গান’ প্রবন্ধে মওলানা আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরীকেই এ গানের উদ্ভাবক বলে অভিহিত করেছেন।

মতামত দিন