বাংলাদেশের প্রাচীন গির্জা: চট্টগ্রামের ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’

Posted by

বাংলাদেশের প্রাচীন গির্জা , ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’। চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা এলাকার বান্ডেল সড়কে অবস্থিত প্রাচীনতম এ গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬০০ সালে।

বাংলাদেশের প্রাচীন গির্জা
বাংলাদেশের প্রাচীন গির্জা , ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’।

পর্তুগিজরা সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে আসে ১৫১৮ সালে। পাঁচশ বছর ধরে কর্ণফুলী দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের গোড়ার ইতিহাসও অনেকের অজানা।

ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদেরও এখন আর নজর নেই পর্তুগিজদের ইতিহাসে।

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের পর্তুগিজদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে ‘সিটি অফ বাংলা’র নাম। এই ‘সিটি অফ বাংলা’ ছিল চট্টগ্রাম। পর্তুগিজদের লেখায় চট্টগ্রামের উচ্চারণ ছিল ‘চাটিগাম’।

৫০০ বছর আগে ১৫১৮ সালে পর্তুগিজ বণিকরা যখন চট্টগ্রামে আসেন, সঙ্গে সঙ্গে এই অঞ্চলে প্রথম খ্রিস্টধর্মের প্রচলন হয়।

পরবর্তীতে এই খ্রিস্টবিশ্বাস তৎকালীন পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।

এ সময় চট্টগ্রামকে পর্তুগিজরা সংখ্যায় বাড়ার পাশা-পাশি; খ্রিস্টধর্ম প্রচারে আসতে শুরু করেন আরও অনেকে। বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয় চার্চ।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

তার অংশ হিসেবে ‘আওয়ার লেডি অব দি হলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’ নামে চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম প্রধান গির্জাটি ১৬০০ সালে পর্তুগিজ খ্রিস্টানরা নিজেদের প্রার্থনার উদ্দেশে তৈরি করেন।

পূর্ববঙ্গে খ্রিস্টধর্মের ৫০০ বছর

২০১৯ সালে পূর্ববঙ্গে বা চট্টগ্রামে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আগমনের ৫০০ বছর পূর্তিতে দুইদিনের উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৫১৮ সালে চট্টগ্রামের দেয়াং পাহাড় এলাকায় পর্তুগিজ বণিকদের হাত ধরে পূর্ববঙ্গে খ্রিস্ট বিশ্বাসীরা আসেন।

১৫৩৭ সাল থেকে পর্তুগিজ বণিকরা চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের ধর্মীয় যত্ন নিতে দক্ষিণ ভারতের কোচিন এলাকা থেকে ১৫৯৮ সালে বঙ্গদেশে প্রথম খ্রিস্টান মিশনারীরা আসেন।

১৫৯৯ সালে দেয়াংয়ে এ অঞ্চলের প্রথম গির্জাঘরটি নির্মাণ করেন ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ। পরের বছর পাথরঘাটা ব্যান্ডেলে ও জামালখান এলাকায় আরও দুইটি গির্জা নির্মাণ করেন।

কালের সাক্ষী  ‘বাংলাদেশের প্রাচীন গির্জা’

পাথরঘাটা ক্যাথিড্রাল চার্চচট্টগ্রামের পাথরঘাটার বান্ডেল রোডের পাশে ৪০০ বছরের পুরানো ক্যাথিড্রাল চার্চ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা ভবন ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন গির্জা

পূর্ববঙ্গের প্রথম খ্রিস্ট শহীদের সমাধির ওপরই চট্টগ্রামের ক্যাথেড্রাল গির্জা। বর্তমানে এই গির্জার নাম ‘পবিত্র জপমালার রানি’।

স্থানীয়ভাবে এটি বান্ডেল ক্যাথলিক চার্চ এবং ‘পাথরঘাটা গির্জা’ নামেও পরিচিত।

খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে প্রাচীন গির্জা রয়েছে পনেরোটি। এরমধ্যে চট্টগ্রাম পাথরঘাটা ব্যান্ডেল রোডের ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’ সবচেয়ে প্রাচীন।

এক সময় চট্টগ্রামকে প্রাচ্যের রানি অভিধা দিয়েছিলেন পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ ক্যাম্পোজ। ক্যাম্পোজের মতনই চট্টগ্রামে এসে বসবাস করেছিলেন বহু পর্তুগিজ।

তাঁদের স্মৃতিচিহ্ন আজও বহন করে চলেছে পাথরঘাটার গির্জা।

গির্জারই পরিচালনা সমিতির তথ্য মতে, চট্টগ্রামে পর্তুগিজরা প্রথমে কেবল বর্ষাকালেই ব্যবসা করত। বর্ষা শেষ হলে গোয়ায় ফিরে যেত।

কেননা, গোয়া ছিল পর্তুগিজদের অন্যতম ঘাঁটি।

চট্টগ্রামের ক্যাথেড্রাল গির্জা
গির্জার দেওয়াল ফলক

পরে অবশ্য পর্তুগিজরা বাংলায় স্থায়ী বসতি গড়ে তোলে; বিভিন্ন জায়গায় উপাসনার জন্য প্রার্থনা ভবন তৈরি করে। তার মধ্যে এই গির্জাটিও। এটি চট্টগ্রামে রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান গির্জা।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পর্তুগীজ খ্রিস্টানরা আসে ১৫১৮ সালে। তবে ১৫৩৭ সাল থেকে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

তাদের প্রথম মিশনারি ছিল তিনটি। তাহলো-সন্ন্যাসব্রতী, প্ররৈতিকি এবং জেসুইট সংঘ। সেন্ট জন দ্যা ব্যাপ্টিস্ট নামে প্রথম গির্জা স্থাপিত হয় ১৬০০ সালের ২৪ জুন। দুই বছর পর সেটি ধ্বংস করা হয়।

পরবর্তীতে প্রথম গির্জার ধ্বংসস্তুপের উপর ‘পবিত্র জপমালা রাণী’ নামে গির্জা এবং ১৮৪৩ সালে বিশপ ভবনের দালানটি নির্মাণ করা হয়।

১৬০০ সালে নগরীর জামালখানের গির্জাটিও তৈরি করা হয়।

ফাদার ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ এস জে ও আন্দ্রে বোভে তৎকালীন আরাকান রাজার আর্থিক সাহায্য নিয়ে গির্জাটি নির্মাণ করেন।

১৬০২ খ্রিস্টাব্দে মগ দস্যুদের হাতে ধ্বংস হওয়ার পর ১৮৩৪ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয় এই গির্জা।

মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন- 

বর্তমান ক্যাথেড্রালটি ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল এবং শেষ সংস্কারটি হয়েছিল ১৯৩৩ সালে।

এক একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত গির্জার উপাসনালয়ে ৫০০ লোকের বসার জায়গা আছে। গির্জার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে যিশুর ম্যুরাল ও তেলরঙে আঁকা ছবি।

এপিটাফের উপর লেখা

হোলি রোজারি গির্জার সমাধিস্থল
হোলি রোজারি গির্জা সংলগ্ন সমাধিস্থলে লেখা আছে বাংলায় পর্তুগিজদের ইতিহাস

‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’ গির্জার অভ্যন্তরে রয়েছে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের কবরস্থানে।

এই কবরস্থানে আছে সাধারণ খ্রিস্টানদের পাশাপাশি এই গির্জায় দায়িত্ব পালনকারী ফাদারদের কবর।

কবরস্থান চিরনিদ্রায় শায়িতদের আপনজনরা এপিটাফে তাঁদের হৃদয়ের অনুভূতি লিখে রাখেন।

এপিটাফের উপর লেখা এসব অনুভুতি আপনার হৃদয় ছুঁয়ে যাবে।

ব্যতিক্রমধর্মী সমাধি

গির্জার কবরস্থানে সাদা মার্বেল পাথরে মোড়ানো স্যার হেনরি লিল্যান্ড হ্যারিসনের সমাধিটি ব্যতিক্রমধর্মী। কারন এই সমাধিতে ভেতরে প্রবেশের জন্য সিঁড়ি রয়েছে।

হেনরি লিল্যান্ড হ্যারিসন একজন লেখক ছিলেন। তাঁর লেখা বই বেঙ্গল ইমবেকমেণ্ট ম্যানুয়ালে বাঁধ এবং নদীর প্রবাহ সম্পর্কে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বর্ণনা রয়েছে।

হ্যারিসনের সমাধির এপিটাফ থেকে জানা যায় তিনি ১৮৩৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহন করেন এবং ১৮৯২ সালের ৫ মে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন।

স্মৃতিস্তম্ভ

স্মৃতিস্তম্ভবাংলাদেশের প্রাচীন গির্জা ‘আওয়ার লেডি অফ দ্য হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল চার্চ’  তৈরি হয় সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে এমনটা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশের মানিক উইলভার ডিকস্তা।

তার মতে , ‘পবিত্র জপমালার রানি’ গির্জার পূর্বদিকে রয়েছে বাংলায় প্রথম খ্রিস্ট শহীদ ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ এস জে-এর স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ।

তিনি স্পেনের টলেডোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে। প্রথম খ্রিস্টান মিশনারি হিসেবে তিনি চট্টগ্রামে আগমন করেন ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে।

তিনি বাংলায় প্রথম জেসুইট মিশনের প্রধান অধ্যক্ষ ছিলেন ১৫৯৮ থেকে ১৬০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

ফাদার ফ্রান্সেসকো আরাকানীদের হাতে দাস হিসেবে আটক কিছু শিশুকে বাঁচানোর চেষ্টা করায় আরাকানীরা তাকে বন্দী করে।

কারাগারে বন্দী অবস্থায় তিনি নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন ১৬০২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর।

মতামত দিন