জব্বারের বলীখেলা, শতবর্ষী পুরানো চট্টগ্রামের সার্বজনীন এক উৎসবের নাম। ১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ লালদীঘি ময়দানে এই বলীখেলার সূচনা করেন ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর।
জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত ‘জব্বারের বলীখেলা’ শতবর্ষী পুরানো চট্টগ্রামের সার্বজনীন এক উৎসবের নাম।
বাংলা পঞ্জিকার বৈশাখ মাসের ১২ তারিখে প্রতি বছরই ঐতিহাসিক লালদিঘী মাঠে এই আয়োজন করা হয়।
বলী খেলাকে ঘিরে লালদিঘী মাঠের আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকে বৈশাখী মেলার আয়োজন।
তিনদিন ধরে চলে এই মেলা। এটিকে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
চট্টগ্রামের মুরব্বিদের ভাষ্য, চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের ১৯টি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল।
প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী, সাহসী পুরুষ এবং তাঁদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরত প্রদর্শন।
এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলীখেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলীখেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা।
যেভাবে শুরু হয়েছিলো এই প্রতিযোগিতা
বাংলার লোকঐতিহ্যের বিচিত্র ভাণ্ডারের অতুলনীয় সব উপাদানের মধ্যে লোকক্রীড়া অন্যতম।
খেলাগুলোতে অংশ নিয়ে ছেলেমেয়ের দল কিংবা পরিণত বয়সের লোকেরা লাভ করে নিছক বিনোদন।
তবে বিনোদনের আনন্দ উপভোগ করার পরও লোকজীবনের দৈনন্দিন ও সামাজিক আচার-ব্যবহার—এককথায় লোকঐতিহ্যের বিভিন্ন স্মারক এগুলোতে সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
বলীখেলা আমাদের লোকক্রীড়াগুলোর মধ্যে ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি খেলা। বলী খেলা মানে কুস্তি প্রতিযোগিতা।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলী খেলা নামে ডাকা হয়। জব্বারের বলীখেলা’র ইতিহাস বেশ প্রাচীন।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ: চট্টগ্রামের বনেদী ‘সওদাগরী পাড়া’
- কালুরঘাট সেতু: ঐতিহ্যের স্মারক হালুরঘাডর পোল!
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
বাংলা-বিহার-ওডিশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর এ দেশে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয়।
একসময় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। শুরু হয় স্বদেশি আন্দোলন।
বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর প্রেরণা থেকেই চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলীখেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন।
১৩১৬ বঙ্গাব্দের ১২ বৈশাখ। গ্রেগরিয়ান হিসাব মতে সনটি ছিল ১৯০৯। চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর এক কুস্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন।
তার মৃত্যুর পরে এ খেলা পরিচিতি পায় জব্বারের বলীখেলা নামে।
সেই থেকে প্রতি বছর একই তারিখে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ঐতিহ্যবাহী এ বলিখেলা।
একনজরে জব্বারের বলীখেলা
- আব্দুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সাল থেকে এ খেলার প্রচলন করেন।
- বর্তমান চ্যাম্পিয়ন চকরিয়া উপজেলার তারিকুল ইসলাম জীবন।
- জব্বারের বলীখেলা’য় এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ চ্যাম্পিয়ন দিদার বলী। তিনি সর্বোচ্চ ১৩ বার বিজয়ী হয়েছেন।
- বর্তমানে এটি দেশের বড় লোকজ উৎসব।
- প্রতি বছরই ২৫শে এপ্রিল ঐতিহাসিক লালদিঘী মাঠে এই আয়োজন করা হয়।
- প্রথমবারের মত স্থগিত ২০২০ সালের আয়োজন।
ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়া সুদূর আরাকান অঞ্চল থেকেও ‘বলি’রা এ খেলায় অংশ নিতে আসতেন।
অতীতকালে রাজা-বাদশা কিংবা জমিদারদের কাছে কুস্তিগীরদের কদর ছিল। বীরের মর্যাদা পেতেন তারা।
আধুনিক যুগে শত্রু দমনে নতুন নতুন অস্ত্র ব্যবহারের ফলে কমতে থাকে কুস্তিগীরদের কদর।
অতীতের সেসব ঐহিত্য হারাতে বসলেও বৃহত্তর চট্টগ্রামের কিছু শৌখিন কুস্তিগীর বলিখেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।
তবে এখন বলীখেলার আগের জৌলুস আর নেই। অন্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং আধুনিকতার সয়লাবে বলীখেলার জোয়ারে কিছুটা ভাটা পড়েছে। কিন্তু উৎসবের কোনো কমতি নেই।
কারণ, এখন বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। খেলার আমেজ কিছুটা কমলেও লালদিঘীর বৈশাখী মেলা সগৌরবে জানান দেয় তার অতীত ঐতিহ্যের কথা।
জব্বারের বলীখেলা বর্তমানে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’তে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়ে থাকে।
বলীখেলাকে ঘিরেই দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব
জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়।
এ খেলা ঘিরেই চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবচেয়ে বড় বৈশাখি মেলার আয়োজনও হয়।
১২ বৈশাখ, ২৫ এপ্রিল বলিখেলার মূল আসর বসলেও আগে পরে প্রায় সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে চট্টগ্রামের লালদিঘী এলাকায়।
এখানকার বৈশাখি মেলার বিস্তৃতি আন্দরকিল্লা-মোড় থেকে লালদিঘীর চারপাশ, হজরত আমানত শাহ (রহ.)-এর মাজার ছাড়িয়ে জেলরোড, দক্ষিণে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়িয়ে কোতোয়ালির মোড় এবং পশ্চিমে সিনেমা প্যালেস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দোকানিরা শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে, কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে হরেক রকম পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন।
বলতে গেলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্যতম পুরানো এবং বড় বৈশাখি মেলা। নানান গ্রামীণ পণ্যের পসরা বসে এই মেলায়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে কুটিরশিল্পীরা নিয়ে আসেন নানান পণ্য।
রমরমা বিক্রি হয় কুটিরশিল্পীদের তৈরি নকশীকাঁথা, মাছ ধরার চাঁই, বেতের তৈরি চালুনি, তৈজসপত্র, তালপাখা, হাঁড়ি-পাতিল, কাঠ-বাঁশ-বেতের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, ঝাড়ু, কুলা, শীতলপাটি,বেতের তৈরি চালুনি, মাছ ধরার চাঁইসহ আরো কত কী!
গৃহকর্ত্রীরা সংগ্রহ করেন গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য তৈজসপত্র।
যেমন, কারুকাজ করা পিঠার ছাঁচ, রুটি বেলার বেলুনি ও পিঁড়া, পোড়ামাটিতে তৈরি বিভিন্ন মৃৎপাত্র, মটকা, মাটির কলস, ফুলদানি ইত্যাদি।
তবে এককালে মেলায় যেমন লোকজ গ্রামীণ পণ্যের আধিপত্য ছিল, বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সেই ঐতিহ্যে কিছুটা হলেও ভাটা পড়েছে।
মৃৎশিল্প কিংবা কারু-দারুশিল্পকে হঠিয়ে প্লাস্টিক-পণ্যও দখল করছে মেলা।
মেলার পাশাপাশি আগত দর্শনার্থীদের জন্য নাগরদোলা, সার্কাস, পুতুল নাচ, যাদু প্রদর্শনী, ভ্যারাইটি-শোর আয়োজন করা হয় লালদিঘি ময়দানে। শহরবাসীরা এই মেলার জন্য সারা বৎসর অপেক্ষা করেন।
বলী সংকটে জব্বারের বলীখেলা!
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে এ মেলার জন্ম। এ মেলার পুরো ঐতিহ্য আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির এক বিরাট অংশ দখল করে আছে।
সেই বলীখেলা বলীর অভাবে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে!
প্রাথমিক কয়েকটি ধাপ শেষে ফাইনালে মনোনীত করে বলীদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
খেলাশেষে বিজয়ী বলীকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে মেলায় ঘুরানো হয় এবং তাদের দেখার জন্য উৎসুক জনতা ভিড় জমায়।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- কর্ণফুলী নদী: হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের অমর সাক্ষী!
- বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার: ‘বোস্তামীর কচ্ছপ’ পৃথিবীতে বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রাণী
- ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা: ‘তর্কহীন ভাবে সর্বকালের সেরা’
তবে, এখন বলীদের সুযোগ-সুবিধা ও তত্ত্বাবধান না থাকার কারণে এখন সেই আগের মত কুস্তিগীর পাওয়া যায় না।
আগের সেই কালু বলী, সামসু বলী, আজিজ বলী, হেমায়েত বলী, দিদার বলী এখন আর দেখা যায় না।
ঐতিহ্যবাহী খেলাটি টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। তা না হলে শুধু মেলাই থাকবে। বলী পাওয়া মুশকিল হবে। ঐতিহ্য হারাবে বলীখেলা।
১১১ বছরে এসে থমকে গেল বলীখেলা!
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তরুণদের শরীর গঠনের ওপর জোর দিতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালে লালদীঘির মাঠে বলীখেলা প্রবর্তন করেন।
১৯০৯ সাল শুরু পর “প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমনকি ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও থেমে থাকেনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিযোগিতাটি।”
কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের থাবায় ১১০ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে এবারই প্রথম স্থগিত করা হলো এই খেলা ও তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দান ছাড়াও আরো কয়েকটি স্থানে বলীখেলা বর্তমানে প্রচলিত।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কক্সবাজারে ডিসি সাহেবের বলী, সাতকানিয়ায় মক্কার বলী, আনোয়ারায় সরকারের বলী, রাউজানে দোস্ত মোহাম্মদের বলী এবং চান্দগাঁওতে মৌলভীর বলী।