ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি অনন্য স্থাপত্যকীর্তি চট্টগ্রাম আদালত ভবন । এক সময়ের কালেক্টরেট বিল্ডিং; এখন কোর্ট হিল বা কোর্ট বিল্ডিং। কারও কারও কাছে কাচারি পাহাড়। তবে, এই পাহাড়ের আদি নাম ‘পরীর পাহাড়’।
১৮৯২-৯৮ সালে পরীর পাহাড়ে ইন্দো-ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিং একটি উপনিবেশিক স্থাপত্যকীর্তি।
ইউরোপীয় ও মুগল ঐতিহ্যের সম্মিলিত ধারায় লোকজ নানা অলঙ্করণে নির্মিত বিশেষ এই স্থাপত্যশৈলীর অবতারণা হয় অবিভক্ত বাংলায়।
মুগল মসজিদ স্থাপত্যের গভীর প্রভাব পড়েছে দালানটির ভূমি নকশায়।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭৩ সালে চট্টগ্রামকে পৃথক প্রশাসনিক অঞ্চল ঘোষণা করে। এসময় প্রশাসনিক কাজের জন্য এই দ্বিতল ভবনটি ( চট্টগ্রাম আদালত ভবন) নির্মাণ করা হয়।
এর আয়তন ১,৫৩,০০০ বর্গফুট ও কক্ষ সংখ্যা শতাধিক।
এখান থেকে জেলা প্রশাসক, বিভাগীয় কমিশনার ও আদালতের কার্যাবলী পরিচালিত হয়। এছাড়া জেলা ট্রেজারি এখানে অবস্থিত।
জনদাবীর পরিপ্রেক্ষিতে শতাব্দীর প্রাচীন চট্টগ্রাম আদালত ভবন এর পশ্চিমাংশ সম্প্রতি সংস্কার করা হলেও পুরাকীর্তি আইনের আওতায় আনা হয়নি এই প্রত্নসম্পদ।
পরীর পাহাড় বা কোর্ট হিল চট্টগ্রামের কিংবদন্তি
মধ্যযুগে চট্টগ্রাম বন্দর ও চট্টগ্রাম নিয়ে ত্রিপুরার রাজারা, গৌড়ের সুলতানগণ, মোগল সুবাদারগণ ও আরাকানি মগ এই চারশক্তির মধ্যে যুদ্ধ হত।
পর্তুগিজ জলদস্যুরা মগদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতো। পূর্তগজিরা মগদের সহায়তায় পুরো চট্টগ্রামে লুটতরাজ চালাতো।
১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াস উদ্দীন মাহমুদ শাহের পতনের পর থেকে ১৬৬৬ খ্রীস্টাব্দে মোগল বিজয়ের আগ পর্যন্ত চট্টগ্রামসহ দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গের অন্যান্য সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাসমুহ থেকে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যু কর্তৃক মানুষ চুরির ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- আন্দরকিল্লা মসজিদ: মুসলিম ঐতিহ্যের স্মারক
- কালুরঘাট সেতু: ঐতিহ্যের স্মারক হালুরঘাডর পোল!
- বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার: ‘বোস্তামীর কচ্ছপ’ পৃথিবীতে বিলুপ্তপ্রায় ও দুর্লভ প্রাণী
চাকমা রাজার নাচ-গানের আসর, জ্বীন-পরীদের অবাধ বিচরণ, পীর বদর শাহ (র.) কর্তৃক অলৌকিকভাবে জ্বীন-পরী বিতাড়নের ঘটনা, কদল খাঁন গাজী কর্তৃক চট্টগ্রাম থেকে মগবাহিনী বিতাড়ন, আরাকানি মগ দস্যুদের চট্টগ্রামে মানুষ চুরির ঘটনা, জ্বীন-পরীর মানুষ চুরির গল্প তখন পুরো চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তাছাড়া আধুনিক কোর্ট হিল সেই সময় জঙ্গলাকীর্ণ ও দুর্গম ছিল বিধায় পর্তুগিজ জলদস্যু ও আরাকানি মগ দস্যুদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়।
উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলোর সাথে কিছু সত্য, কিছু মিথ্যা, কিছু উপকথা , কিছু লোকগাথা ও কল্প-কাহিনী যুক্ত হয়ে (চট্টগ্রাম আদালত ভবন) এলাকা বা কোট হিলকে ‘পরীর পাহাড়’ নামে আখ্যায়িত হতে সাহায্য করেছিল। এই ধারনাটিকে বস্তুবাদী বলে অনেকেই সমালোচনা করেন।
ঐতিহ্য পরীর পাহাড় থেকে চট্টগ্রাম আদালত ভবন
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে তাদের আধিপত্য বিস্তারে এতদ্বাঞ্চলে কলকাতার পর চট্টগ্রামকে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতো।
২৩ জুন ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পূর্বে তারা দুইবার চট্টগ্রাম বিজয়ের চেষ্টা করে।
প্রথমবার ১৬৮৬ খৃ. মি. নিকোলাস আর দ্বিতীয়বার ১৬৮৮ খৃ. মি. চারনাক ও হিথ নামক ইংরেজ সেনাপতি চট্টগ্রাম আসার চেষ্টা করেন।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তন ও অন্য নানা কারণে তা হয়ে ওঠেনি।
অতঃপর ১৭৬০ খৃ. তৎকালীন বাংলার নামমাত্র নবাব মীর কাশিম সনদ নং-৬১৬২ তাং-১৫ অক্টোবর মূলে মেদিনীপুর, বর্ধমান ও চট্টগ্রামসহ তিনটি জেলা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দান করেন। সূত্র : (চট্ট. ইতি., পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, পৃ: ৭৩-৭৪)।
আবদুল হক চৌধুরী রচিত ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ পাঠে জানা যায়, বার্ষিক ১ লাখ টাকা রাজস্বের বিনিময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামে দেওয়ানী শাসনভার লাভ করে, (পৃ: ৬১)।
তখন চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন মোহাম্মদ রেজা শাহ। আর এরই সাথে চট্টগ্রামের মুসলমানদের ৯৬ বছরের (১৬৬৬-১৭৬০) শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬০ সালের ডিসেম্বর Hr. Harry Verlest কে প্রধান করে চট্টগ্রামে তিন সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিল ফোর্ট উইলিয়মের গভর্নর গঠন করে।
Hr. Harry Verlest এর সঙ্গে Mr. Wilkins মেম্বার ও এসিস্ট্যান্ট হয়ে চট্টগ্রাম আসেন, ৫ জানুয়ারি ১৭৬১ খৃ.। তারা মোহাং রেজা খাঁ হতে শাসনভার গ্রহণ করেন।
প্রশাসন চালুর জন্য তারা সর্বপ্রথম তৎকালীন মাদরাসা পাহাড় নামে পরিচিত পাহাড় শীর্ষে জজ ও আলাসদর আদালত স্থাপন করেন ।
এর সংলগ্ন পশ্চিম পাহাড়ে সদর মুন্সেফি ও অন্য একজন আলাসদর আমীনের কাচারি ছিল, আর লাল কুঠিতে ছিল ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টরের কাচারি ও তেরজুরি।
ক্রমে ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি হেতু কর্তৃপক্ষ সরকারি অফিস, জজ আদালত, সদর মুন্সেফি আদালত, পর্তুগিজ ফিরিঙ্গি মারকট সাহেবের পাহাড়ের কুঠিতে, কমিশনারের অফিসে টেম্পেস্টহিলের পূর্ব পাহাড়ে আনা হয়।
এরপর নব স্থাপিত সড়ক দফতরসহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সকল অফিস আদালত কাচারি একত্র করে ফেয়ারি হিলে আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ফেয়ারি হিলের ইতিকথা
চট্টগ্রাম যখন মগ রাজাদের শাসনাধীন ছিল, তখন ফেয়ারিহিল ও টেম্পেস্টহিল নামক দুটি পাহাড় পর্তুগিজ ফিরিঙ্গিদের দখলে ছিল। তখন এই স্থান দুর্গের অভ্যন্তরে ছিল ও জন হেরী নামক জনৈক পর্তুগিজের দখলে ছিল।
কাপ্তান টেকসরা সাহেব তার নিকট থেকে ঐ দুটি পাহাড় খরিদ করেন। টেকসরা সাহেব থেকে ফেয়ারিহিল পেরাডা সাহেব প্রাপ্ত হন।
তার নিকট থেকে পটিয়ার ছনহরা গ্রামের খ্যাতনামা জমিদার বাবু অখিলচন্দ্র সেন ৯০০০/- টাকা (নয় হাজার) মূল্যে ক্রয় করেন এবং দখলদার হন।
এর উত্তর অংশের টেম্পেস্টহিল টেকসরা সাহেব হতে হস্তান্তরিত হয়ে নোয়াখালীর বাঁশপাড়ার জমিদার রাজকমল, রাজবল্লভ সাহাদের হস্তাগত হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ফেয়ারিহিলে পর্তুগিজ আমলে ডাক্তারখানা ছিল, তখন অনেকগুলো অতি প্রাচীন ঝাউগাছ সারিবদ্ধভাবে দৃষ্ট হতো যেগুলোর এক একটি বেড় আনুমানিক ২০-২৫ হাত পর্যন্ত ছিল বলে ঐতিহাসিক শ্রী পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী তার লেখায় উল্লেখ করেন।
মুসলিম আমলে এ স্থান অব্যবহৃত থাকায় জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল এবং এতে মাত্র একটি ভগ্ন কুঠির বিদ্যমান ছিল।
এখানে পরীর বাসস্থান ছিল বলে সেকালের লোকজন বিশ্বাস করতো। ওই সময় থেকে ঐ পাহাড় ফেয়ারিহিল পরী বা অপ্সরা পর্বত নামে পরিচিতি লাভ করে।
আরও জানা যায়, একসময় ফেয়ারিহিলের ওপর দক্ষিণাংশে একখানা পুরাতন কুঠি ছিল, যেখানে বুলক ব্রাদার্সের এজেন্ট সাহেব থাকতেন।
গভীর ও ভয়ানক জঙ্গলে জ্বীন, পরী, বাঘ-ভালুকসহ হিংস্র জানোয়ারের আস্তানায় একজন ইউরোপিয়ান আত্মহত্যা করেছিলেন আর দিনের বেলায় ফিরিঙ্গি বাজারের একজন মুসলমানকে বাঘে হত্যা করে। সূত্র : (চট্ট. ইতি. পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, পৃ: ৯২)।
গোটা চট্টগ্রাম শহর জ্বীন-পরীর আস্তানা ছিল বলে যে জনশ্রুতি আছে- তারই সূত্র ধরে সত্য মিথ্যা কল্পকাহিনীর বদৌলতে ফেয়ারিহিল পরীর পাহাড় ছিল বলে মানুষ বিশ্বাস করতো, এতে বিচিত্র হওয়ার কিছু নেই।
সারা চট্টগ্রাম থেকে জ্বীন-পরী, দৈত্য-দানব, পীর-আউলিয়ার পদচারণায় তিরোহিত হয়েছে এরই ধারাবাহিকতায় এবং মানুষের প্রয়োজনেই ফেয়ারিহিলে কথিত পরীর স্থান দখল করেছে মানুষ।
চট্টগ্রাম আদালত ভবন নির্মাণ
ইংরেজ শাসনের ১২৮ বছর অতিক্রান্তে ১৮৮৯ সালে জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসন ফেয়ারিহিলের ভূমি জমিদার অখিলচন্দ্র সেন থেকে অধিগ্রহণ করে।
ইংরেজ প্রশাসন চালুর ১৩২ বছরের মাথায় ইংরেজ গভর্নমেন্ট ফেয়ারিহিলের শীর্ষে ১৮৯৩-৯৪ সালে কলকাতার প্রশাসনিক ভবন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের আদলে ইংরেজ ও মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে ৫,৬৫,৩৭২/- টাকা ব্যয়ে ১০১০০০ বর্গফুট আয়তনের এতদ্বাঞ্চলের সর্ববৃহৎ দ্বিতল ইমারত নির্মাণ করেন।
নানান কারুকার্য খচিত অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন এই ভবন দক্ষিণ দিক থেকে দুই গম্বুজবিশিষ্ট অংশ বিশেষ অনেকটা ইংরেজি ‘W’ আকারের দ্বিতল, উত্তর দিক থেকে ‘T’ আকারের, অংশবিশেষ ত্রিতল, পূর্বদিক থেকে ‘L’ আকারের মনে হয়।
বিভিন্ন দিক থেকে এই ভবনকে ভিন্ন ভিন্ন ভবন বলে মনে হয় এবং এর নির্মাণশৈলীর অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
এই বিশাল ভবনে ১৫০টির মতো কক্ষ আছে। কক্ষগুলো এক একটি এতবড় যে, যেগুলোর আয়তন ৩৫০০-৪০০০ বর্গফুট হবে।
আপনি যদি চারদিক থেকে আদালত ভবন দেখেন তবে এর অনুপম সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বলে উঠবেন চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিং এর, একইসঙ্গে এতরূপ!
নির্মাণ কাজ সমাপনাস্তে মাদরাসা পাহাড়, লালকুঠিসহ বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো ছিটানো সরকারি দফতরগুলো চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিং এ এনে সুবিন্যস্তভাবে সাজানো হয়।
এর দক্ষিণাংশে সিভিল কোর্ট, দোতলা পূর্ব জেলা দায়রা জজ, মধ্যাংশে দোতলা উকিল খানা, দোতলা পশ্চিমাংশে জেলা প্রশাসক কার্যালয়, নিচতলা পশ্চিমাংশকে মহাফেজখানা, দোতলা সর্বপশ্চিমে কমিশনার অফিসসহ পুরো ভবনে মুন্সেফি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, কেরানীখানা, ল্যান্ড রিকুইজিশন, ইনকাম ট্যাক্স, ফরেস্ট, ট্রেজারি, একাউন্টস, সার্টিফিকেট, তৌজিখানাসহ অল্পকিছু সরকারি দফতর ছাড়া সব সরকারি দফতর এই ভবনে স্থানান্তরিত হয়।
চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিং হয়ে উঠে চট্টগ্রামের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র রূপে।
এই ভবন শুধু বিচার ও প্রশাসনিক বিভাগের নানা দফতরই নয়, এখানে রক্ষিত আছে সিপাহী বিদ্রোহ, বিদ্রোহী সুবেদার রজব আলী, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের নায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসি, ১৯০৫-১১ সাল পর্যন্ত স্বদেশী আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ, প্রাচীন আরাকান, ত্রিপুরা রাজ্য, মোগল, পাঠন-বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিলপত্র।
চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিংয়ের মূল প্রবেশদ্বার বরাবর উঁচুতে শ্বেতমর্মরে উৎকীর্ণ আছে, আল্লাহ তালার শাশ্বত বাণী- ‘বল, তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার।’
চট্টগ্রাম আদালত ভবন রক্ষা আন্দোলন
বৃটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলায় কলকাতয় রাইটার্স বিল্ডিং, ঢাকার কার্জন হল, চট্টগ্রামের সিআরবি ও কোর্ট বিল্ডিংয়ের নির্মাণশৈলীতে অনেক মিল থাকলেও চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংই অবিভক্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইমারত।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর সময়ের চাহিদার কোর্ট বিল্ডিংয়ে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পাকিস্তান সরকার অনেকটা অবিবেচনাপ্রসূত পরিকল্পনাহীনভাবে ৬০ বছরের পুরাতন চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিংকে ত্রিতল ভবনে রূপান্তর করে।
বয়স, দায়সারা গোছের রক্ষণাবেক্ষণ এবং মাথার ওপর চাপিয়ে দেয়া বোঝার কারণে শতায়ু পেরোনের অনেক আগেই এই ভবন ক্ষয়িঞ্চু ভবনের কাতারে এসে দাঁড়ায়, ছাদ ও পলেস্তরা খসে পড়তে শুরু করে এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
অথচ কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের অনেক পূর্বে আর কার্জন হল ও সিআরবি সমসাময়িক কালে নির্মিত হলেও এসব ভবন পরিচর্যা ও যত্নের কারণে তাদের অস্তিত্ব ও সৌন্দর্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
প্রথম ধাপে ১৯৮৫ ইং এই ঐতিহ্যসমৃদ্ধ চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিংকে ব্যবহারের সম্পূর্ণ অনুপযোগী ঘোষণা করে গণপূর্ত বিভাগ। একই বছরের ৪ মে গণপূর্ত প্রকল্প অধিদফতরের ৫ প্রকৌশলীই আদালত ভবনকে পুরাকীর্তি হিসেবে ছাড়পত্র প্রদান করেন।
তারা কোর্ট বিল্ডিংয়ের ব্যাপারে দুটি প্রস্তাব পেশ করেন।
একটি হলো ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরাতন চট্টগ্রাম আদালত ভবন ভেঙে নতুন আদালত ভবন তৈরি; আর অন্যটি হলো বর্তমান ভবনটির কাঠামো ও স্থাপত্যশৈলী অটুট রেখে এর গঠন কাঠামো আরও মজবুত করার লক্ষ্যে আমূল সংস্কার ও মেরামত।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে নতুন আদালত ভবন নির্মাণ ও পুরাতন চট্টগ্রাম আদালত ভবন ভাঙার জন্য দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও প্রচার করে গণপূর্ত বিভাগ।
ইতোমধ্যে বুয়েটের ৫ সদস্যবিশিষ্ট টেকনিক্যাল কমিটির বিশেষজ্ঞ কমিটি সরেজমিন পর্যবেক্ষণ চালিয়ে বৃটিশ আমলের পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা ও তা সংরক্ষণের দাবি জানানো হয়।
এ দাবিতে স্মারকলিপি প্রদান, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে চট্টগ্রামের সুশীলসমাজ, পেশাজীবী, বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, গুণীজনসহ সর্বস্তরের মানুষ।
বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট মামলা করা হয়, যার নং-৫৮২৮/২০০১।
মামলায় চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিংকে পুরাকীর্তি ঘোষণা ও তা সংরক্ষণ এর আদেশ দান ও নতুন আদালত ভবন নির্মাণসহ যাবতীয় উদ্যোগকে বাতিল ঘোষণার আবেদন জানানো হয়।
৯ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ কমিটি আদালত ভবন পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের মতামত দেন। রক্ষা পেয়ে যায় শতাব্দী প্রাচীন চট্টগ্রামের ইতিহাসের অনন্য স্মারক চট্টগ্রাম আদালত ভবন।
১১৮ বছর পর নতুন আদালত ভবন
ব্রিটিশআমল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ। ব্যবধান ১১৮ বছর। চট্টগ্রামে আরেকটি নতুন আদালত ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।
বিশাল পরিসরের নতুন আদালত ভবনটি এ অঞ্চলের বিচারকাজের জন্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ১১৮ বছর আগে ১৮৯২ সালে তত্কালীন ব্রিটিশ সরকার উপমহাদেশের স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে চট্টগ্রামের পরির পাহাড়ের ওপর চট্টগ্রাম আদালত ভবন বা কোর্ট বিল্ডিং নির্মাণ করে।
ওই ভবনে চলছে চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার বিভিন্ন আদালতের বিচারকাজ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে এ ভবন থেকে।
স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বিচারক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাজ করতে হচ্ছে। অনেক সময় এজলাশ কক্ষে বিচারপ্রার্থীদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না।
এ অবস্থার অবসান ঘটে নতুন আদালত ভবন নির্মাণের ফলে।
সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গণপূর্ত অধিদপ্তর ভবনটি নির্মাণ করে। নতুন আদালত ভবনে ৪৬টি এজলাশ কক্ষ আছে।
জানা গেছে, এক যুগ আগে ১৯৯৮ সালে তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভবনটি ভেঙে নতুন আদালত ভবন নির্মাণের চেষ্টা হয়।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- কিংবদন্তির ‘চেরাগী পাহাড়’ আছে কেবল নামেই
- জিভে জল আনা চাটগাঁইয়া (মেজবান) মেজ্জানের একাল-সেকাল
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকদের বাধার কারণে স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে ১১৮ বছর আগে নির্মিত পুরোনো ভবন ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। পুরনো ভবনের পাশেই নির্মাণ করা হয় নতুন আদালত ভবন।
চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগের তথ্য মতে, ১১৮ বছর পর চট্টগ্রামে নতুন আদালত ভবন নির্মিত হয়েছে।
প্রায় আড়াই লাখ বর্গফুট আয়তনের নতুন ভবনটি এ এলাকার বিচারকাজে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
এতে বিচারক, বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীরা উপকৃত হবেন। বিচারকেরাও স্বাচ্ছন্দ্যে ও সুন্দর পরিবেশে কাজ করতে পারবেন।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ১৭ মার্চ নতুন আদালত ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয়।
রাজধানী ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। এতে খরচ হয়েছে ২২ কোটি ৭৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
চারতলা নতুন আদালত ভবনের আয়তন দুই লাখ ৪৬ হাজার ৭১১ বর্গফুট।
এ অঞ্চলের মধ্যে চট্টগ্রাম নতুন আদালত ভবন সবচেয়ে বড় ভবন বলে জানা গেছে, যা চট্টগ্রাম পুরোনো আদালত ভবনের আয়তনের দ্বিগুণের বেশি।
পুরোনো আদালত ভবনের আয়তন এক লাখ ১৮ হাজার ২০২ বর্গফুট।
নতুন আদালত ভবনে সব ধরনের আধুনিক সুবিধা পাওয়া যাবে। যেমন বিচারকদের ব্যবহারের জন্য দুটি লিফট ও নিচে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে।
তথ্যসূত্র : পত্রিকা, আর্টিকেল, ওয়েব, ব্লগ থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত।
তেরজুরি কি। বিস্তারিত জানতে চাই