চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, শহরের কোলাহল ও যান্ত্রিকতা মুক্ত সবুজ পাহাড়ে ঘেরা ১৭৫৩ একরের আয়তনের দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। যা ভ্রমনপিপাসুদের পিপাসা মেটায় !
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আয়তনে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ক্যাম্পাস। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চবির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে পাহাড়ি এবং সমতল ভূমির বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজে ঘেরা এই শিক্ষাঙ্গন।
যেখানে সকাল হয় শাটলের ঝকঝক কিংবা হুইসেল ধ্বনিতে। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় সবুজ প্রকৃতি।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে ওঠে কাটাপাহাড়ের রাস্তা। ভিড় জমতে থাকে ঝুপড়িগুলোয়।
প্রাকৃতিক শোভামণ্ডিত চবি’র পুরো আঙিনা দেখতে অপরূপ। দৃষ্টিজুড়ে নান্দনিক, অপ্সরী। নান্দনিক সৌন্দর্যের পুরোধা।
সৌন্দর্যপিপাসুদের কাছে পরম আকর্ষণীয়। ভ্রমণের পিপাসা মেটায় চিরসবুজ-শ্যামল এই সোনালি ক্যাম্পাস।
পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা চবি কেবল আগামীর দেশ গঠনের কারিগর তৈরি করছে না, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের আঙিনায় আশ্রিতও করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।
সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় -এর যাত্রা যেভাবে
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রামে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চট্টগ্রামের মানুষ স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করে।
১৯৪০ সালে সর্বভারতীয় সম্মেলনে মওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সভাপতির ভাষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ নির্মাণের কথা উপস্থাপন করেন। পরে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেয়াং পাহাড়ে কিছু জমি কিনেন।
১৯৪২ সালে নূর আহমদ বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি পেশ করেন।
ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- চুয়েট: যেখানে ডানা মেলে হাজারও শিক্ষার্থীর স্বপ্ন
- হাটহাজারী মাদ্রাসা: উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কওমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
- কেন পেশাদার ই-মেইল ঠিকানা থাকাও জরুরি?
পরে ১৯৬২ সালের নির্বাচন প্রচারণায় ফজলুল কাদের চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাধারণ প্রতিশ্রুতি দেন।
পরবর্তীকালে তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৯৬৪ সালের ৯মার্চ অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করা হয়।
১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করে।
পৃথিবীর একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়
কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করবে; পৃথিবীতে এমন ট্রেন আছে শুধু চবিতে। শহর থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটারের।
তাই শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ১৯৮০ সালে চালু হয় শাটল ট্রেন।
পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্রটা এখানেই। যুক্তরাষ্ট্রের গান ফ্রান্সিসকো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিবহনের জন্য ছিল নিজস্ব ট্রেন।
কিন্তু বর্তমানে তা বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই পৃথিবীর একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয়।
চবির ট্রেনের ঠিকানা কিংবা গন্তব্য বটতলি থেকে ক্যাম্পাসের জিরো পয়েন্ট। দুটো শাটলের পাশাপাশি আছে ১টি ডেমুও।
প্রতিদিন প্রায় দশ থেকে বার হাজার শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় যাতায়াতের মাধ্যম এই শাটল ও ডেমু ট্রেন।
শাটল দেখতে শুধু যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন তা কিন্তু নয়। বিদেশ থেকেও শাটল দেখতে চবিতে আসার অনেক নজির আছে। শাটলই হলো চবির প্রাণ।
অনেকে এই শাটলকে ‘ভ্রাম্যমাণ বিশ্ববিদ্যালয়’ও বলেন। আড্ডা, গল্প, গান, পড়ালেখা কী নেই এই শাটলে! বিভিন্ন বগিতে সবাই একসঙ্গে গান গেয়ে মাতিয়ে রাখেন পুরো ট্রেন।
এই ট্রেন নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘লাভ ইন শাটল ট্রেন’। অভিনয় করেছেন চবির শিক্ষার্থীরা।
সমৃদ্ধ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি
দেশের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম চবির গ্রন্থাগার। দেশি-বিদেশি সাড়ে তিন লাখ বই, ম্যাগাজিন, পাণ্ডুলিপি দিয়ে এ অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এটি।
১৯৬৬ সালের নভেম্বরে যাত্রা শুরু সংক্ষিপ্ত পরিসরে। ১২০০ বর্গফুট বিশিষ্ট ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে তখন বই ছিল মাত্র ৩০০টি।
১৯৬৮ সালে ১৪ হাজার বই নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে গ্রন্থাগারটির পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়।
১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কিছুদিনের জন্য গ্রন্থাগারটি বর্তমান প্রশাসনিক ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।
বর্তমানে ৫৬ হাজার ৭০০ বর্গফুট পরিমিত গ্রন্থাগারের অবস্থান হলো কলা অনুষদের দক্ষিণ পাশে চাকসু ভবনের পূর্ব পাশে ও দৃষ্টিনন্দন আইটি ভবনের পশ্চিম পাশে।
আধুনিক ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারটি ১৯৯০ সালে উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য আলমগীর মো. সিরাজ উদ্দিন। গ্রন্থাগার ভবনে কলা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, সমাজবিজ্ঞান, আইন অনুষদের পৃথক পাঠকক্ষ রয়েছে।
গ্রন্থাগারের সংগৃহীত পাঠ-সামগ্রীকে ৫ ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে আছে, প্রধান সংগ্রহ, জার্নাল সংগ্রহ রেফারেন্স সংগ্রহ, চবি প্রশাসন থিসিস দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ।
জার্নাল শাখায় দেশি-বিদেশি প্রকাশিত সাময়িকী। পুরনো সংখ্যাগুলো বাঁধাই করে ডিডিপি পদ্ধতি অনুসরণ করে সাজিয়ে রাখা হয়।
রেফারেন্স শাখায় রয়েছে গবেষণা রিপোর্ট, বিশ্বকোষ অভিধান, হ্যান্ডবুক, ম্যানুয়েল, পঞ্জিকা, এনজিও প্রকাশনা, আইএলও ইউনেস্কো, বিশ্বব্যাংক আইএমএফ, ইউনিসেফ বিবিএস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা।
গ্রন্থাগারের দুষ্প্রাপ্য ও পাণ্ডুলিপি শাখায় এমন কতগুলো সংগ্রহ আছে যেগুলো প্রাচীন ভুজপত্র, তানপত্র, তুনট কাগজে লেখা।
এই শাখায় রয়েছে গবেষকদের গবেষণাকর্মের উপাত্ত হিসেবে চিহ্নিত প্রাচীন পাণ্ডুলিপি, দুর্লভ বই, দলিল।
দুষ্প্রাপ্য শাখায় এমন কিছু সংগ্রহ আছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো গ্রন্থাগারে নেই। এখানে ১৮৭২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রকাশিত পুরনো সাময়িকী আছে।
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অঞ্জলি, অনুসন্ধান পূর্ব পাকিস্তান, অগ্রগতি, সীমান্ত, পূরবী, পাঞ্জজন সাধনা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, প্রবাসী ভাণ্ডার প্রতিভা, প্রকৃতি, ঢাকা রিভিউ, পূর্ণিমা ছায়াবীথি, বার্তাবহ, সাপ্তাহিক এডুকেশন গেজেট, আলো ইসলাম প্রচারক, আল-ইসলাম, ভারতী মার্যাব্রু ইত্যাদি।
চবি’র গর্ব সমৃদ্ধ তিনটি জাদুঘর
চবিতে আছে গর্ব করার মতো সমৃদ্ধ তিনটি জাদুঘর। গ্রন্থাগারের কোলঘেঁষে নব্বইয়ের দশকে গড়ে উঠেছে এখানকার সমৃদ্ধ ও বৃহত্তম জাদুঘরটি।
ছোট টিলার ওপর স্থাপিত এ জাদুঘরে ঢুকতেই চোখে পড়বে হাজার বছর পুরনো গাছের ফসিল।
নিচতলায় রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র ও আলোকচিত্র স্টুডিও, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাগার, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কোষ গ্রন্থাগার। তৃতীয় তলায় আছে পাঁচটি গ্যালারি।
প্রথমটি ‘প্রাক-ঐতিহাসিক গ্যালারি’। আছে মাছের ফসিল, বৌদ্ধবিহারের নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, সপ্তম শতাব্দীর কুমিল্লা কোটবাড়ি থেকে সংগৃহীত ল্যাম্পস্ট্যান্ড, কোটবাড়ির পোড়ামাটির ফলক, সোমপুর বিহারের পোড়ামাটির ফলক।
দ্বিতীয়টির নাম ‘ভাস্কর্য গ্যালারি’। এ গ্যালারিতে আছে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম শতাব্দীর কষ্টিপাথরের ভাস্কর্য।
তৃতীয়টির নাম ‘ইসলামিক শিল্পকলা গ্যালারি’। এ গ্যালারিতে রয়েছে হাতে লেখা কোরআন শরিফ, নকশে সেলেমানি, পাণ্ডুলিপি লেখার সরঞ্জাম, মধ্যযুগের অস্ত্রশস্ত্র, কামান, কাব্য সংকলন, ১২০৯ সালের আলমগীরনামা, ফারসি ভাষার গুলিস্তা, ১২২৯-৩৬ সালের কাবিননামা, ১০৬১ হিজরিতে লেখা মেপতাহুস সালাত, ফিরোজ শাহ-মোবারক শাহ-ইলিয়াস শাহ-মাহমুদ শাহ-সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং আকবরের আমলের পুরনো পয়সা।
চতুর্থ গ্যালারি ‘লোকশিল্প গ্যালারি’। এখানে আছে রথযাত্রার দৃশ্যাবলি, নিদ্রারত কুম্ভকর্ণ, শ্রীকৃষ্ণের জীবনচিত্র, রাম-রাবণের দুধের দৃশ্যাবলি, হাতির দাঁতের পাখি, রাজকীয় লাঠির মাথা, তাঁতশিল্প, মধ্যযুগের অলঙ্কার, হাঁসুলি, কোমরের চেইন, প্রথম যুগের সিরামিক, হাতপাখা, কলের গান ও বাঘের মাথা।
পঞ্চমটি ‘আর্ট গ্যালারি’। এখানে আছে বর্তমান যুগের চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, মর্তুজা বশির, এস এম সুলতান, হাশেম খান ও আবদুর রশিদের নানা চিত্রকর্ম।
চবিতে আছে আরও দুটি জাদুঘর। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে রয়েছে একটি জাদুঘর (প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর)।
১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে একটি সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ জাদুঘরটি স্থাপিত হয়।
এই জাদুঘরে প্রায় ৫৪০টি নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে প্রাণীর সংখ্যা ৫৭টি এবং ফরমালিন (ভেজাসংরক্ষিত) নমুনার সংখ্যা ৪৮৫টি।
অপরটি হলো সমুদ্র সম্পদ জাদুঘর: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের একটি রুমে গড়ে তোলা হয়েছে এ জাদুঘর।
এখানে ৫৫০টির মতো সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ করা হয়েছে। হাঙ্গর থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক মাছ, আজব বাণাকেল, অক্টোপাস, শামুক, সাপসহ রয়েছে অসংখ্য বিস্ময়কর জীববৈচিত্র।
দেশমাতৃকার বর্ণিল প্রতিচ্ছবি – স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য
চবির বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের বর্ণিল স্মৃতিচিহ্ন। এসব স্থাপত্যশিল্প দেখলেই এই প্রজন্মের মনে দেশমাতৃকার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দেশপ্রেম জেগে উঠবে।
ক্যাম্পাসে শোভা পাচ্ছে আবদুল করিম ভবন (কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবন) ও গ্রন্থাগারের মাঝখানে ’৫২ এর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে চলা ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল।
পাশেই ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের শার্ট নিয়ে শোকাহত মানুষের ঢল! তারই পাশে তর্জনী উঁচিয়ে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু! ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনের ২৪ বছরের ইতিহাস ফুটে উঠেছে চবির ‘স্বাধীনতা ম্যুরাল’ এ।
আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা নিয়ে ক্যাম্পাসে আছে ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’, ‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’ ও ‘বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ’।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথেই সাত মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ’ ভাস্কর্যটি।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন শিক্ষক, ১১ জন ছাত্র এবং ৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে।
স্মৃতিস্তম্ভে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে।
অনন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এ বিদ্যাপীঠ যেন প্রকৃতি আর মানব প্রাণের মেলবন্ধন।
সবুজ বৃক্ষসারির উপর উড়ন্ত বিচিত্র রঙের হরেক রকম পাখি, সবুজ পাহাড়ের কোলে থাকা হরিণ, অজগর কিংবা বিচিত্র আর দুর্লভ প্রাণীর জীবন্ত জাদুঘর চবি ক্যাম্পাস।
ঝুলন্ত সেতু,ঝর্ণাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান, জাদুঘর, রহস্যময় চালন্দা গিরিপথ কিংবা সুবিশাল মাঠ কি নেই চবি ক্যাম্পাসে!
ষড়ঋতুর পালাবদল হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায় চবি ক্যাম্পাসে।
বর্ষার আগমনে প্রকৃতির সতেজতা লাভ, শরতের কাশফুল, হেমন্তের সোনালী ধান কিংবা ঋতুরাজ বসন্তে ফোঁটা ফুল সবই দেখা যায় চবি ক্যাম্পাসে থেকে কিংবা গিয়ে।
প্রকৃতি তার অপার মহিমায় সাঁজিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে। চবি ঝর্ণা, ঝুলন্ত সেতু, কাটাপাহাড়সহ মানবসৃষ্ট স্থাপনাগুলোও যে কাউকে আকৃষ্ট করবে।
কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের পেছনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন এক পাহাড়ি ঝর্ণা।
পাহাড় থেকে নেমে আসা জলরাশির খেলা ও ঝরনার পাশের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে আসা প্রকৃতিপ্রেমিদের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই স্থানটি।
এছাড়া, রাঙামাটির সৌন্দর্যও দেখা যায় চবি ক্যাম্পাসে। রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতুর মত চবিতেও রয়েছে হৃদয়কাড়া এক ঝুলন্ত সেতু। সেতুটি সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের কাছে অবস্থিত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ক্যাফেটেরিয়া রয়েছে। একটি চাকসু ভবনের নিচ তলায় আরেকটা আইটি ফ্যাকাল্টিতে। সারাদিন ছাত্রছাত্রীদের কোলাহলে ব্যস্ত থাকে ক্যাফেটেরিয়াগুলো।
ঝুপড়ির মধুর আড্ডা
চবির বিভিন্ন অনুষদ ও হলগুলোর পাশে রয়েছে সারি সারি অনেক দোকান। এসব দোকানকে ঝুপড়ি নামে ডাকা হয়।
চবি শিক্ষার্থীদের আড্ডার অন্যতম জায়গা এই ঝুপড়িগুলো।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্বাদু আর রুচিশীল খাবারগুলোর উৎস হলো এসব ঝুপড়ি।
হরেকরকম ভর্তা আর নানা মজাদার খাবারের জমজমাট আয়োজন করে বিভিন্ন অনুষদের সঙ্গে থাকা পাহাড়ের কোলঘেঁষে টিনের ছাউনিতে নির্মিত এই ঝুপড়িগুলো।
অপেক্ষাকৃত অল্প দামে খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, গরম ভাত কিংবা ভর্তার জন্য অপেক্ষমাণ শত শত শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখর এই ঝুপড়িগুলো।
যেন ধনী, মধ্যবিত্ত, নিন্ম মধ্যবিত্ত এবং গরিব শিক্ষার্থীদের এক মিলনমেলা।
যেখানে সবাই সমান, সহযাত্রী সবাই রাজা, সবাই বাদক, গায়ক কিংবা আড্ডাবাজ। কলা অনুষদের ঝুপড়ি, সমাজ বিজ্ঞানের ঝুপড়ি, লেডিস হলের ঝপড়ি এদের মধ্যে অন্যতম।
ফরেস্ট্রি এলাকা এবং জীববৈচিত্র
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকটা দৃষ্টিনন্দন করেছে ফরেস্ট্রি এরিয়া।
ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের উদ্যোগে করা সবুজ বনায়ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসকে একটি আকর্ষনীয় পর্যটন স্পটে পরিণত করেছে।
৫০ একর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত ফরেস্ট্রি এরিয়া সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন। এখানে রয়েছে হেলিপ্যাড, লেক, সুইমিংপুল, মেমোরিয়াল গার্ডেন ইত্যাদি।
এছাড়া, পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠা এবিশ্ববিদ্যালয়ের আকাঁবাকাঁ পথ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও বন্যপ্রাণী যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী।
কাটা পাহাড়ে, বাণিজ্য অনুষদের পেছনে কিংবা ফরেস্টিতে দেখতে পাওয়া যায় বাদামী রংয়ের হরিণ। হরিণগুলো বেশ লাজুক ও মায়াবী
অন্যদিকে, অগণিত লুকায়িত আকর্ষণের ভিড়ে চবি ক্যাম্পাসে রয়েছে রহস্যময় চালন্দা গিরিপথ।
প্রাকৃতিক ঝরনা, পাহাড়ের প্রাণজুড়ানো রূপে বহুদিন ঢাকা পড়েছিল চালন্দা গিরিপথের সৌন্দর্য।
কলা অনুষদের ঝুপড়ির ছড়ার পানি দিয়ে ৫০মিনিট পশ্চিমে হাটার পর ছড়ার বামে বা দক্ষিণে এই রহস্যময় মায়াবী সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সেখানে হাটু পরিমাণ পানি আছে কিছু কিছু জায়গায়।
পাহাড়ের বিশুদ্ধ পানি সমৃদ্ধ এ গিরিপথ ধরে এগুতে থাকলে দেখা যাবে সেখানে পাহাড়ের আদা-সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদের অভূতপূর্ব দৃশ্য।
প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রতিদিনই উপভোগ করতে যায় নয়নাভিরাম সেই সৌন্দর্য। চালন্দা গিরিপথ হয়ে উঠেছে অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
হল জীবনের হইহুল্লোর
প্রায় ২৮ হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে ১২টি আবাসিক হল। এর মধ্যে ৮টি ছেলেদের জন্য আর ৪টি মেয়েদের। এছাড়া বৌদ্ধ ছাত্রদের জন্য রয়েছে গোবিন্দ গোণালংকার ছাত্রাবাস।
আড্ডা, মজার অনুভুতিগুলো ও শেয়ার করা, রাত জেগে পড়াশোনা, ঘুমাতে গেলে ছাড়পোকার সঙ্গে যুদ্ধ সবই উপভোগ করা যায় হলগুলোতে।
রুমমেট অসুস্থ হয়ে পড়লে নির্ঘুম রাত জেগে সেবা করা এগুলো হল জীবনের নিত্য নৈমত্যিক ঘটনা।
সুখে দুঃখে একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো কাঁটে এখানকার শিক্ষার্থীদের।
হলে থাকা একাধিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হল জীবন জুড়ে জড়িয়ে থাকা হাজারো আবেগ ও অনুভুতির কথা।
এত গেল সৌন্দর্য, ঐতিহ্য আর হল জীবনের কথা।
তুমি যদি বিভিন্ন কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের সঙ্গে যুক্ত হতে চাও, তাও আছে সব উপাদান। আছে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
বর্তমান সময়ে বিতর্কশিল্প বেশ জনপ্রিয়।
ক্যাম্পাসে আছে দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিতর্ক সংগঠন ‘চিটাগং ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি’। আবৃত্তির জন্য আছে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি মঞ্চ’।
সংস্কৃতি চর্চার জন্য আছে অঙ্গন ও উত্তরায়ণসহ বিভিন্ন সংগঠন।
আছে সাংবাদিক সমিতি, ক্যারিয়ার ক্লাব, ছায়া জাতিসংঘ, হিস্ট্রি ক্লাব, সাহিত্য সংসদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরসহ প্রয়োজনীয় এবং জনপ্রিয় সব সংগঠন।
আছে জিমনেশিয়াম এবং সুবিশাল খেলার মাঠ। সবুজাভ প্রকৃতি আর ঝর্ণার স্বচ্ছ জলধারা স্বাগতম জানাচ্ছে তোমায়। আগামীর স্বপ্ন বিনির্মাণে বেছে নিতে পার এই ক্যাম্পাসকে।
এক নজরে চবি
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর হাটহাজারিতে ১৭৫৩ একর পাহাড়ি এবং সমতল ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
চবির প্রথম উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিক। বর্তমান উপাচার্য শিরীণ আখতার। আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় এটি।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- কিংবদন্তির ‘চেরাগী পাহাড়’ আছে কেবল নামেই
- জিভে জল আনা চাটগাঁইয়া (মেজবান) মেজ্জানের একাল-সেকাল
- চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ‘বেলা বিস্কুট’ উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট!
২০১৯ সালের হিসাবে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২৭,৮৩৯ শিক্ষার্থী এবং ৮৭২ জন শিক্ষক রয়েছেন।
২০২০ সালের হিসেবে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অনুষদের অধীনে ৫৪টি বিভাগ রয়েছে।
এছাড়া, বর্তমানে ৭টি ইনস্টিটিউট এবং ৬টি গবেষণা কেন্দ্রের পাশা-পাশি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্ন্তভূক্ত রয়েছে।
২০২০ সালের হিসেবে, দেশে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৯ম এবং বৈশ্বিক অবস্থান ৩১০১ তম।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে ১ জন নোবেল বিজয়ী এবং একাধিক একুশে পদক বিজয়ী অর্ন্তভূক্ত রয়েছেন।
করোনার ( কোভিড-১৯) জিন বিন্যাস উন্মোচন করলেন চবি গবেষকরা
চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে প্রথমবারের মত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি’র) একদল গবেষক কোভিড-১৯ এর জিনের বিন্যাস উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) করেছেন।
২০২০ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বিভাগের কোভিড-১৯ এর ওপর সার্বিক চিত্র তুলে ধরা, সে লক্ষ্যে আমরা প্রত্যেকটি (১১টি) জেলার প্রত্যেক উপজেলা/থানা থেকে কোভিড পজিটিভ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছি।
তারপর, আরএনএ এর পরিমাণ (কনসেনট্রেশন) ও গুণের (কোয়ালিটি) ওপর ভিত্তি করে ৪৬টি নমুনা জিনোম সিকোয়েন্সিং এর জন্য নির্বাচন করি। যার মধ্যে ৩৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স ৯৯% এর ওপরে উন্মোচিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে ১২টি নমুনার জিনের বিন্যাস গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা (GISAID) ডেটাবেইসে জমা দেওয়া হয়েছে।’
সুন্দর