আজ সারা বিশ্বে যখন বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হচ্ছে, তখন বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের ওপর চাপ ও ভয়ভীতি আমাদের যারপরনাই উদ্বিগ্ন করে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণ করে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ এবং মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে।
১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ এর স্বীকৃতি দেয়া হয়।
প্রতিবছরের মতো সারাবিশ্বের সাথে বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হচ্ছে।
দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘কিপিং পাওয়ার ইন চেক: মিডিয়া, জাস্টিজ এন্ড রোল অব ল’।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে তথ্যমন্ত্রণালয়ে এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, দেশের উন্নয়নকে টেকসই, গতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক করতে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কোনো বিকল্প নেই।
বর্তমান সরকার অনুসৃত এ অন্যতম মূলমন্ত্র বাস্তবায়নে কাজ করছে তথ্য মন্ত্রণালয়। উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশের গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করার দৃঢ় প্রত্যয় সে কাজেরই অংশ।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ১৪টি সংস্থার সহায়তায় দেশে তথ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে জনগণ একদিকে উন্নয়নমূলক কাজের বিষয়ে আরো সচেতন হচ্ছে, অন্যদিকে জনগণের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে সরকারও অবহিত হচ্ছে।
এ দু’য়ের কার্যকর সমন্বয়ে এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত বাংলাদেশ।
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- ইসলামে সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকতার মূলনীতি
- `ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে`: সাংবাদিকতা ও ইসলাম
- একজন মসরুর জুনাইদ ও ‘নান্দনিক সাতকানিয়া আন্দোলন’
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকাকে বর্তমান সরকার সবসময় বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে এসেছে উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়, তারই অংশ হিসেবে সরকারের ধারাবাহিক দুই মেয়াদের বিগত ৮ বছরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের বাস্তবসম্মত কার্যক্রম দেশের উন্নয়নে গণমাধ্যমের অপরিহার্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
অর্থাৎ টেকসই উন্নয়নে গণমাধ্যমের অংশগ্রহণ যে আবশ্যক- তথ্য মন্ত্রণালয়ের তৎপরতায় এটি আজ দৃঢ়প্রতিষ্ঠ।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজকে আরো গতিশীল করা, আইনের আওতায় আনা এবং সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের দায়বদ্ধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে গত আট বছরে ১৫টি আইন, বিধি ও নীতিমালা প্রণীত হয়েছে।
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর আওতায় গঠিত তথ্য কমিশন ইতোমধ্যে ২০ হাজারেরও বেশি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিয়েছে বলে নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়াও বলা হয়, ৬৪টি জেলায় জনঅবহিতিকরণ সভার মাধ্যমে এ আইন সম্পর্কে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট আইন ২০১৩ এর আওতায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (বিসিটিআই) এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৪ এর আওতায় স্থাপিত সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট দেশের গণমাধ্যমের উৎকর্ষ ও কল্যাণে শুধু নজীরবিহীন দৃষ্টান্তই তৈরি করেনি, আগামী দিনগুলোতে গণমাধ্যমকে সমৃদ্ধ করতে দিয়েছে প্রাতিষ্ঠানিকতার স্থায়ীরূপ।
সাংবাদিকদের কল্যাণে যুগান্তকারী ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন ২০১৪’ এর আওতায় গঠিত ১৩ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ড বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআইবি) স্থাপিত অস্থায়ী কার্যালয়ে ট্রাস্টের কাজ শুরু করেছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ট্রাস্টের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন পিআইবির মহাপরিচালক।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট-এর অনুকূলে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা বরাদ্দসহ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে সিডমানি হিসেবে ৫ কোটি টাকা জমা আছে।
নবগঠিত এ ট্রাস্ট এবং সাংবাদিক সহায়তা ভাতা/অনুদান নীতিমালা ২০১২ এর আওতায় ২০১১ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ৫ কোটি ১০ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছেন ৮১৯ জন অনুদানভোগী।
গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। গণমাধ্যম স্বাধীন হলে তার সুফল সবাই ভোগ করে। সে হিসেবে সাংবাদিকতা আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে। কথায় বলে, ‘যত বড় মাথা তত বড় ব্যাথা।’
যে পেশার গুরুত্ব যত বেশি, এই প্রবাদ বাক্যের আলোকে সেই পেশার দায়বদ্ধতাও তত বেশি। বাংলাদেশের আপামর জনগণ এ দৃষ্টিকোণ থেকেই সাংবাদিকদের ভিন্ন চোখে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে থাকে।
বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা দেশ ও জাতির তথা বিশ্ব মানব সম্প্রদায়ের কল্যাণে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম- এ ব্যাপারে ন্যূনতম সন্দেহ-সংশয় নেই।
বর্তমান সময়ের আধুনিক সাংবাদিকতার বিশাল পরিসরে সাংবাদিককে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় বেঁধে দেওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়।
এখন সংবাদপত্রের ধরনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি সাংবাদিকদের কাজের পরিধিতেও পরিবর্তন এসেছে। সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। তবুও সাংবাদিকদের শত্রুর অভাব নেই।
এক কথায়, একটি অনিশ্চিত পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের।
অথচ দেশের সামগ্রিক কল্যাণময় কাজে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে সংবাদমাধ্যম।
তারপরও একশ্রেণীর লোক সর্বদা তাদের যাবতীয় আক্রোশ উগরে থাকে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতি।
এ ক্ষেত্রে অবশ্য এককভাবে তাদেরও দায়ী করা যায় না।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, এ জন্য সাংবাদিক নিজেও দায়ী। অর্থাৎ সাংবাদিক তার কলম, মেধা ও মননশীলতার অপব্যবহার করেছেন।
সাংবাদিকদের হাতে কলম আছে বলেই তারা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলতে পারেন না।
এমনটি সুস্থ সাংবাদিকতার বিপরীত কাজ। এটা অন্যায়ও বটে। ক্ষেত্রবিশেষ দেখা যায়, অনেক সাংবাদিক মিথ্যা ও বানোয়াট খবর প্রচার করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায়কে সমর্থন করছে।
ইসলামী শরিয়ত এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বিশেষ নির্দেশ প্রদান করেছে। নিষেধ করা হয়েছে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হওয়ার।
ইসলাম বলেছে মানবকল্যাণের জন্য সত্য সংবাদ পৌছে দিতে। তাই সংবাদ সংগ্রহের সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। যেনতেন লোক থেকে সংবাদ গ্রহণ করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে সূরা হুজরাতের ৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে লিপ্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।’
হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট, যা শুনবে তা যাচাই ছাড়া বর্ণনা করা।’ [আবু দাউদ]
সততা একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় গুণ। অনেক যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকলেও সততার অভাবে অর্জিত সম্মান ধুলোয় মিশে যেতে পারে।
যেহেতু গণমাধ্যমকে সমাজের দর্পণ বলা হয়, তাই গণমাধ্যমকর্মীদেরও দর্পণের মতো স্বচ্ছ হতে হবে। এটা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশবিশেষ ও বিশেষ ভূষণও বটে।
সাংবাদিক হলেই যা ইচ্ছা তা লেখা যাবে না। এমন কিছু প্রচার করা যাবে না, যাতে মন্দ ছাড়া ভালো কিছু নেই।
এ ছাড়া সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করে সংবাদ পরিবেশনসহ অন্যের ক্রীড়নক হয়ে বা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সংবাদ পরিবশেন চলবে না।
এমন কাজ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে সতর্ক করে বলেছেন, ‘আর যে বিষয় তোমার জানা নাই তার অনুসরণ করো না।
নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তকরণ- এদের প্রতিটির ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে।’ -সূরা বনি ইসরাঈল : ৩৬
একজন সাংবাদিককে সংবাদ লিখতে হবে শতভাগ সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে। কেননা সাংবাদিক কারও পক্ষের নন। তিনি ন্যায়-ইনসাফ ও সত্যের পক্ষপাতী। সাংবাদিক বন্দী তার বিবেকের কাছে।
এ বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ইনসাফ কর।’ -সূরা আনআম : ১৫২
সাংবাদিকদের শুধু রাজনৈতিক সংবাদ ছাপলে চলবে না। দেশের মানুষ কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কী করছেন সেসব বিষয়ের সংবাদও প্রকাশ করতে হবে।
সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট না করা ও কারও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করে এমন বিষয়গুলো মাথায় রেখে সংবাদ লিখতে হবে।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এক হাদিসে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের কবিরা গুনাহ সম্পর্কে সংবাদ দেব না? (কথাটি রাসূল (সা.) তিনবার বলেছেন) সাহাবায়ে কেরামরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! বলুন, তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া, কথাগুলো বলার সময় রাসূল (সা.) হেলান দিয়ে বসেছিলেন, অতঃপর সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। কথাগুলো বারবার বলতেছিলেন। আমরা (সাহাবারা) মনে মনে বলতেছিলাম, ‘হায়! যদি তিনি চুপ হতেন।’ [বুখারি ও মুসলিম]
মসরুর জুনাইদ-এর ব্লগে আরও পড়ুন-
- সাংবাদিকতা নয়, পাবলিক রিলেশনস
- ভাল রেডিও উপস্থাপনার চাবিকাঠি
- ইসলামে সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকতার মূলনীতি
যেহেতু আল্লাহতায়ালা সাংবাদিকদের মেধা দিয়েছেন, যোগ্যতা দিয়েছেন; তারা লিখতে পারেন, নতুন নতুন অনবদ্য রচনা ও গঠনমূলক লেখা সৃষ্টি করতে পারেন; তাই তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তাদেরকে প্রদান করা এই যোগ্যতা মহান আল্লাহর এক অসীম নিয়ামত, একটি আমানত।
এই আমানতকে কোনোভাবেই বিনষ্ট করা যাবে না, হেলায়-ফেলায় খোয়ানো যাবে না।
লেখকঃ অনলাইন সংবাদপত্র সিটিজি টাইমস ডটকম এর সম্পাদক